দখল করে নেওয়া ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি বাড়িয়ে চলেছে ইসরায়েল। তাদের দখলদারিত্বের কারণে পূর্বপুরুষের ভিটা হারাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। এর পাশাপাশি রয়েছে নিজ ভূমিতে ইসরায়েলি বাহিনীর বিধি–নিষেধ। এসব নিয়ে ক্ষোভ থেকে দশকের পর দশক দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। গত ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে শান্তি আলোচনা শুরু হয় আর ভেস্তে যায়। কিন্তু সমস্যার সমাধান আর হয় না।
ইসরায়েলি হামলায় রক্তাক্ত ফিলিস্তিনিদের ছবি দেখে শিহরিত হয় পুরো বিশ্ব। ফিলিস্তিনিদের রক্তক্ষয়ের একপর্যায়ে সংঘাতের সাময়িক অবসান হলেও কিছুদিন পর আবারও একই ধরনের চিত্র উঠে আসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এভাবে চলছে ইসরায়েল–ফিলিস্তিনি সংঘাত, যার বীজ বোনা হয়েছিল এখন থেকে শত বছর আগে।
১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর ফিলিস্তিন নামে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্যের এই অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় যুক্তরাজ্য। তখন ওই অঞ্চলে বসবাস ছিল সংখ্যালঘু ইহুদি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবদের।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওই অঞ্চলে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেয় যুক্তরাজ্যকে। এরপরই শুরু হয় উত্তেজনা। ইহুদিদের কাছে এটা তাদের পূর্বপুরুষের আবাস, অপর দিকে ফিলিস্তিনি আরবরাও একে নিজেদের ভূমি দাবি করে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা শুরু করে।
১৯২০ থেকে ১৯৪০–এর দশকের মধ্যে আরও অনেক ইহুদি এসে আবাস গাড়েন এই এলাকায়। ইউরোপে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে এখানে চলে আসে অনেক ইহুদি পরিবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী যে ইহুদি গণহত্যা (হলোকাস্ট) শুরু করে, তারপর নিজেদের একটি ‘দেশ’–এর আকাঙ্ক্ষায় ইহুদিরা চলে আসতে থাকেন।
এরপর থেকেই ইহুদি ও আরবদের মধ্যে সংঘাত বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনও।
১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে ইহুদি ও আরবদের জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্রের পক্ষে ভোট হয় জাতিসংঘে। ওই প্রস্তাবে জেরুজালেমকে একটি আন্তর্জাতিক শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইহুদি নেতারা এ পরিকল্পনা মেনে নিলেও প্রত্যাখ্যান করেন আরবরা। পরে আর তার বাস্তবায়ন ঘটেনি।
জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে সমস্যার সমাধান করতে না পেরে ১৯৪৮ সালে ওই এলাকা ছেড়ে যান ব্রিটিশ শাসকেরা। তখন ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। ফিলিস্তিনিরা এর তুমুল বিরোধিতা করেন এবং সূচনা হয় যুদ্ধের। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোও জড়িয়ে পড়ে এ যুদ্ধে, তাদের সেনারাও অংশ নেয়।
এ সময় লাখ লাখ ফিলিস্তিনি পালিয়ে যায় বা ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে তাদের বাধ্য করা হয়। এটাকেই ফিলিস্তিনিরা ‘আল নাকবা’ বলে থাকেন, যা অর্থ ‘বিপর্যয়’।
যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে পরের বছর ওই লড়াই থামলেও ফিলিস্তিনের অধিকাংশ এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় ইসরায়েল। পশ্চিম তীর নামে ফিলিস্তিনের আজকের ভূমিটি চলে যায় জর্ডানের দখলে এবং যে গাজা এখন ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু, সেটি চলে যায় মিসরের দখলে। ভাগ হয়ে যায় জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণও। শহরটির পশ্চিমাংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় ইসরায়েলি বাহিনী আর পূর্ব অংশ নিয়ন্ত্রণে রাখে জর্ডান বাহিনী। কোনো শান্তি চুক্তি না হওয়ায় অমীমাংসিতই থেকে যায় এই ইস্যু। এরপর দশকের পর দশক ধরে সংঘাত চলছে।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর, গাজা, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং মিসরের সিনাই উপত্যকা দখল করলে আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়। ইসরায়েলের সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলোর ছয় দিনের ওই যুদ্ধ হয়।
এ সময় শরণার্থী হওয়া অধিকাংশ ফিলিস্তিনি এবং তাদের বংশধরেরা গাজা ও পশ্চিম তীরের পাশাপাশি প্রতিবেশী জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননে বসবাস করছেন। তাদের বা তাদের উত্তরসূরি কাউকেই আর স্বভূমিতে ফিরতে দেয়নি ইসরায়েল। তারা ফিরলে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে যুক্তি দেয় তারা।
ইসরায়েল এখনো পশ্চিম তীর দখল করে আছে। গাজার থেকে তারা সৈন্য প্রত্যাহার করলেও জাতিসংঘ এখনো অঞ্চলটিকে অধিকৃত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করে। ইসরায়েল পুরো জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে দাবি করে। অপর দিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দাবি করে। এখন পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রই পুরো জেরুজালেম শহরের ওপর ইসরায়েলের দাবির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।
গত ৫০ বছরে পুরো এলাকায় নিজেদের বসতি বাড়িয়েছে ইসরায়েল। ওই এলাকায় এখন ৬ লাখের বেশি ইহুদি বাস করেন। ফিলিস্তিনিরা বলে আসছেন, ইহুদিদের এ বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা। তবে ইসরায়েল তা নাকচ করে আসছে।
পূর্ব জেরুজালেম, গাজা ও পশ্চিম তীরে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রায়ই উত্তেজনা দেখা দেয়। গাজা শাসন করছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস, যারা বহুবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়েছে। হামাসের হাতে যাতে অস্ত্র না যায়, সে জন্য ইসরায়েল ও মিসর সীমান্তে কঠোর নজরদারি করে।
গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের অভিযোগ, ইসরায়েলি বিধিনিষেধের বেড়াজালে চরমভাবে ভুগতে হয় তাদের। অন্যদিকে ইসরায়েল দাবি করে, ফিলিস্তিনিদের সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষায় এসব করছে তারা।
এসব কারণেই গত এপ্রিলের মাঝামাঝি মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাসে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়। চলে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পুলিশদের মধ্যে সংঘর্ষ। এর মধ্যে পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররায় কয়েকটি আরব পরিবার উচ্ছেদের মুখে পড়ার ঘটনাও যুক্ত হয়ে পড়ে। সেখান থেকে পরিস্থিতি বড় সংঘাতে রূপ নেয়।
দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বিভেদরেখা টেনে দিয়েছে অনেকগুলো বিষয়, যেগুলো নিয়ে দুই পক্ষ কখনোই একমত হতে পারেনি। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের কী হবে, পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতিগুলো থাকবে কি না সরিয়ে নেওয়া হবে, দুই পক্ষ জেরুজালেম ভাগাভাগি করে নেবে কি না এবং সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে ইসরায়েলের পাশে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে কি না—সেসব বিষয় রয়েছে এখানে।
২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে শান্তি আলোচনা শুরু হয় আর ভেস্তে যায়। কিন্তু সমস্যার সমাধান আর হয় না।
এবারের মতো যুদ্ধবিরতি হলেও শিগগিরই এ সংকটের স্থায়ী কোনো সমাধান আসছে না। সর্বশেষ শান্তি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, তা করা হয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একে ‘শতাব্দীর চুক্তি’ বলে অভিহিত করলেও ফিলিস্তিনিরা একে একপক্ষীয় বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই পরিকল্পনা কখনোই আলোচনার টেবিলে আসেনি।
ভবিষ্যতে কোনো শান্তি চুক্তি হতে হলে এসব জটিল সমস্যার বিষয়ে উভয় পক্ষকে একমত হতে হবে। সে পর্যন্ত সংঘাত চলতেই থাকবে।