ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন। কত কাছে। তবু যেন এক পৃথিবীর দুই প্রান্তরে। এদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, অন্যটি স্বাধীনতার দাবিতে নিয়ত রক্ত ঝরানো শুধুই একচিলতে ভূখণ্ড। প্রথমটি ধরার বুকে সুদৃশ্য এক পরগাছা। গজিয়ে উঠেছে ধূসর ফিলিস্তিনের জমির ওপর। বছর পেরিয়ে বছর আসে, যুগ পেরিয়ে যুগ। কিন্তু ইসরায়েলের দখলদারি? বর্বরতা? ঠিক প্রবহমান ওই নদীর মতোই।
ওদিকে রক্তঝরা ফিলিস্তিনের কী খবর? অবহেলিত ভূখণ্ডটির জনগোষ্ঠীরও ভাগ্য বটে! প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। নিজেদের মাটিতে নিজেরাই পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে। তাও দখলদার ওই ইসরায়েলি ইহুদিদের হাতে। সঙ্গে সড়কে দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল। আর কবরস্থানে? সেখানেও জমছে লাশের স্তূপ। সেই মিছিল চলছে এখনো; লাশের স্তূপও জমছে এখনো। তাতে কী? ইসরায়েল ও তার দোসর যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি-চালবাজি তো ঠিকই আছে।
দখলদার ইসরায়েল আর প্রতিনিয়ত মার খেয়ে চলা, রক্তগঙ্গায় ভাসা ফিলিস্তিনের মধ্যকার অবস্থা ও মর্যাদার এ আকাশ-পাতাল ফারাকের কারণ বুঝতে আমরা একটু পেছনে যাই।
একসময় আজকের এই ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের (সুলতানদের গৌরবময় শাসন) অধীন। আরব মুসলিমরা ছিল এর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। উনিশ শতকের শেষভাগে ইহুদিবাদী আন্দোলন দানা বাঁধলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা, বিচ্ছেদবেদনায় কাতর-অস্থির ইহুদিদের নজর পড়ে এ আরব ভূখণ্ডে। ধীরে ধীরে বিশ্বের এপ্রান্ত, ওপ্রান্ত থেকে ইহুদিরা জড়ো হয়ে এখানে বাসা বাঁধতে থাকে।
এরপর গত শতকের গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের প্রভাবশালী প্রায় সব শক্তি। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে অটোমানদের বিরুদ্ধে তারা লাগিয়ে দেয় আরবদের। একপর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়। ফিলিস্তিনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশরা। ১৯১৭ সালে তারা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসস্থল প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দেয়। সেই থেকে ফিলিস্তিনের বুকে স্থায়ীভাবে শুরু ইসরায়েল নামের দুষ্টক্ষতের বীজ বপন।
পরে বেশ কয়েকবার ইহুদিদের সঙ্গে লড়াই বেধেছে আরবদের। তাতে সুবিধা করতে পারেনি আরবরা। ব্রিটিশ ও ইহুদি জোটের বাড়াবাড়ি মাত্রা ছাড়ালে ১৯৩৬ সালে তাদের দখলদারির বিরুদ্ধে শুরু হয় আরব বিদ্রোহ। নির্মমভাবে দমন করা হয় বিদ্রোহ। তাতে নিহত হয় কয়েক হাজার আরব।
ব্রিটিশ শাসক ও ইহুদিদের সঙ্গে আরবদের বৈরিতা ক্রমেই আরও বাড়তে থাকে। একসময় ফিলিস্তিন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে এর ওপর থেকে কর্তৃত্ব তুলে নেয় ব্রিটিশরা। ফিলিস্তিনদের ভাগ্য নির্ধারণের ভার ছেড়ে দেয় জাতিসংঘের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ববলয়ে থাকা জাতিসংঘও ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনকে দুভাগ করে ইহুদি ও আরবদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের পক্ষে ভোট দেয়। এভাবেই ইউরোপ-আমেরিকার নীলনকশায় ফিলিস্তিনের বুক চিরে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় ভবঘুরে ইহুদিদের। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইহুদি নেতারা একতরফাভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন।
জাতিসংঘের যে অন্যায্য প্রস্তাব অনুযায়ী ইহুদিবাদী ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেই প্রস্তাব মানলেও ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাত দশক পর এখন ইসরায়েল বিশ্বের শুধু পারমাণবিক শক্তিধর দেশই নয়; বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব খাটানো দেশগুলোরও একটি সে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্য মিত্রদের প্রত্যক্ষ মদদে ইসরায়েল এখন জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা, অস্ত্রসহ সব খাতে একরকম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, দখলদারি ও অস্ত্রবাজিও।
যুক্তরাষ্ট্রের আশকারায় ইসরায়েলের ঔদ্ধত্য, দৌরাত্ম্য বর্তমানে এতটাই যে ৭৩ বছর আগে বইতে শুরু করা ফিলিস্তিনে রক্তগঙ্গা বন্ধ হয়নি আজও। এই সময়ে আরব সাগরে অনেক পানি বয়ে গেছে, এর চেয়ে বেশি বয়ে গেছে ফিলিস্তিনিদের কান্না আর রক্ত। তবে আর কত রক্ত ঝরলে সেই গঙ্গার প্রবাহ বন্ধ হবে, সেটি যে অজানাই রয়ে গেল আজও।
কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হটিয়ে প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের নেতৃত্বে গত জুনে ইসরায়েলে নতুন সরকার গঠন করা হয়। এর মাত্র দুই দিনের মাথায় ফিলিস্তিনের গাজায় আবার বিমান হামলা চালায় দেশটির সেনাবাহিনী।
এর আগের মাসেই গাজা উপত্যকায় টানা ১১ দিন মুহুর্মুহু বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে মারা যায় প্রায় আড়াই শ ফিলিস্তিনি, যার মধ্যে ৬৫টিই শিশু। আহত প্রায় দুই হাজার। নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক প্রাণহানিতে তুমুল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্য দিয়ে ওই সহিংসতায় আপাত ক্ষান্ত দেয় ইসরায়েল। তবে চুক্তির পর তিন সপ্তাহ না যেতেই আবার ওই বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল।
নাফতালি বেনেট উগ্র জাতীয়তাবাদী ইয়েমিনা দলের নেতা। একসময় তিনি পশ্চিম তীরে অবৈধ ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের পক্ষে কাজ করা ইসরায়েলিদের সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে তাঁর এ সরকারে রয়েছেন বামপন্থী, মধ্যপন্থী, এমনকি ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের দলের প্রতিনিধিরা। তারপরও কেন নতুন করে হামলা হলো, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নতুন করে ওই উত্তেজনার শুরু ইহুদি জাতীয়তাবাদীদের জেরুজালেম দিবসের ‘ফ্ল্যাগ মার্চকে’ কেন্দ্র করে। ১৯৬৭ সালের মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েলের পূর্ব জেরুজালেম দখলের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জেরুজালেম দিবসে নেচেগেয়ে শোভাযাত্রা করেন ইহুদিরা। এই শোভাযাত্রাকে ফিলিস্তিনিরা দেখেন উসকানি হিসেবে।
ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট জানায়, শোভাযাত্রাকালে ইসরায়েলি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের। এ সময় পুলিশের ছোড়া স্টানগ্রেনেড ও বুলেটে অন্তত ৩৩ ফিলিস্তিনি আহত হন। গ্রেপ্তার করা হয় ১৭ জনকে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি দুই পুলিশ সদস্য সামান্য আহত হন।
ইসরায়েলের মধ্যপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই আয়োজনের প্রশংসা করলেও শোভাযাত্রায় একটি বর্ণবাদী গ্রুপের স্লোগান দেওয়ার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, সেখানে চরমপন্থীরা ছিলেন, যাঁরা ইসরায়েলের পতাকা হাতে ঘৃণা ও বর্ণবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, যা জঘন্য ও সহ্য করার মতো নয়। এটা বোধগম্য নয় যে কীভাবে একজন ইসরায়েলি পতাকা হাতে নিয়ে ‘আরবদের মৃত্যু হোক’ স্লোগান দিতে পারেন।
*তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, বিবিসি, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ও ড্যানিশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (ডিআইআইএস); বিশেষ প্রতিবেদন ‘ফিলিস্তিনের রক্তঝরা ইতিহাস’, সাইফুল সামিন, প্রথম আলো, প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০১৪ ও ‘ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয় না কেন?’, হাসান ফেরদৌস, প্রথম আলো, প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০১৪।