পারমাণবিক চুক্তিতে ইরানের ফেরার পথ কঠিন করছে ইসরায়েল

ইসরায়েল কখনোই এ চুক্তিকে ভালো চোখে দেখেনি। এ বিষয়ে তাদের কৌশল হতে পারে চুক্তি আবারও কার্যকরে সম্ভাব্য আলোচনা থেকে সরে যেতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চাপ দেওয়া। এতে সফল হলে স্বাভাবিকভাবে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়ে উঠবে। ফলে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে না। চাপে থাকবে দেশটির অর্থনীতি।

চলতি বছরের ১০ এপ্রিল ইরানের সামনে উদ্‌যাপনের মতো দুটো উপলক্ষ ছিল। এর আগের সপ্তাহে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে তেহরানের পারমাণবিক আলোচনা শুরু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির পারমাণবিক চুক্তিটি আবারও আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে তেহরানের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফা এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ২০১৮ সালে প্রত্যাহার করে নেন।

অন্যদিকে ওই দিন ইরান উদ্‌যাপন করেছে পারমাণবিক প্রযুক্তিবিষয়ক জাতীয় দিবস। গত বছর রহস্যময় বিস্ফোরণের জেরে দেশটির ইস্পাহান প্রদেশের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ ছিল। ইরানের বিজ্ঞানীরা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুরোপুরি ঠিকঠাক করে কার্যক্রম আবারও চালুর ঘোষণা দেন। তবে খুব বেশি সময় ধরে উদ্‌যাপন করতে পারেননি তাঁরা। পররে দিনই নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রের ওপর আবারও আঘাত আসে।

এ রহস্যময় বিস্ফোরণের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ইরান সরকার। ইরানের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ইসরায়েলের হামলায় নাতাঞ্জ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ–সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্ট্রিফিউজ। এ হামলার কারণে আরও বড় বিপদ ঘটতে পারত। এদিকে খোদ ইসরায়েলের গণমাধ্যমের খবর, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এ হামলা চালিয়েছে।

ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্র

নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার পর ভিয়েনা বৈঠকে এর প্রভাব কেমন হবে, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, ট্রাম্পের আমলে বাতিল হয়ে যাওয়া ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনতে চান তিনি। নতুন করে কার্যকর করতে চান চুক্তিটি। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করে আনবে তেহরান। বাইডেন ইরানের পারমাণবিক ইস্যুতে পূর্বসূরি ট্রাম্পের ঠিক উল্টো পথে হাঁটতে চান। অন্যদিকে ইরানের চাওয়া, বাইডেনকে আগে ট্রাম্পের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

ইসরায়েল কখনোই এ চুক্তিকে ভালো চোখে দেখেনি। এ বিষয়ে তারা দুই ধরনের কৌশল নিতে পারে। প্রথমত, চুক্তি আবারও কার্যকরে সম্ভাব্য আলোচনা থেকে সরে যেতে বাইডেনকে চাপ দিতে পারে। এতে সফল হলে স্বাভাবিকভাবে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়ে উঠবে। ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে না। চাপে থাকবে দেশটির অর্থনীতি। দ্বিতীয়ত, চুক্তিটি দ্রুত কার্যকরে বাইডেনের ওপর চাপ বাড়াতে পারেন। এতে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের গতি টেনে ধরার কৌশল সরাসরি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

উল্লেখ্য, এমন সময় নাতাঞ্জে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যখন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ইসরায়েল সফর করছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় পারমাণবিক কার্যক্রমে গতি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে তেহরান। ইতিমধ্যে আইআর–৯ সেন্ট্রিফিউজের পরীক্ষা চালিয়েছে ইরান। নাতাঞ্জের প্রচলিত আইআর–১এস সেন্ট্রিফিউজের চেয়ে যা আরও ৫০ গুণ বেশি দ্রুতগতির। গত জানুয়ারির পর থেকে ৫৫ কেজি ইউরেনিয়াম ২০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে ইরান, যা পারমাণবিক বোমা বানানোর ক্ষেত্রে দেশটিকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এসব উদ্যোগ স্পষ্টতই সেই পারমাণবিক চুক্তির শর্তবিরোধী।

সাম্প্রতিক হামলার পর ইরান স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, নাতাঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত পুরোনো সেন্ট্রিফিউজ বদলে ফেলা হবে। এখন থেকে আরও আধুনিক মডেলের সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করা হবে। একই সঙ্গে ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ নেবে দেশটি। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম যত জোরদার হবে, ইরান পারমাণবিক বোমা বানানোর পথে ততই এগিয়ে যাবে। তবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ জানিয়ে রেখেছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেয়, তাহলে তেহরানের পক্ষ থেকে উল্টো পথে হাঁটার সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে।

এক দশক আগে ২৪০ কেজি ইউরেনিয়াম ২০ শতাংশ সমৃদ্ধ করেছিল ইরান। তখন কার্যত একটি পারমাণবিক বোমা বানানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল দেশটি। ওই সময় তেহরানের বিরুদ্ধে স্পষ্ট রেডলাইন এঁকে দিয়েছিল ইসরায়েল। এরপরও পিছু হাঁটেনি ইরান। এ কারণেই নাতাঞ্জে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।

গত আগস্টে আবু মুহাম্মদ আল–মাসরি ও নভেম্বরে মোহসিন ফাখরি জাদেহকে হত্যার পেছনে মোসাদ জড়িত বলে অভিযোগ তেহরানের। তাঁরা দুজন ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন।

ইরানের ভূখণ্ডে সামরিক কৌশল এগিয়ে নিতে নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে চরম স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে ইসরায়েল। ২০১৮ সালে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কিত হাজারো নথি হাতিয়ে নেওয়ার মতো দুঃসাহসিক কাজ করেছেন মোসাদের গোয়েন্দারা। গত বছর নাতাঞ্জসহ ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র ও এর আশপাশে বিস্ফোরণ ঘটানো ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পেছনে দায়ী করা হয় গোয়েন্দা সংস্থাটিকে। এমনকি গত আগস্টে আবু মুহাম্মদ আল–মাসরি ও নভেম্বরে মোহসিন ফাখরি জাদেহকে হত্যার পেছনে মোসাদ জড়িত বলে অভিযোগ তেহরানের। তাঁরা দুজন ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন।

এ তো গেল ইরানের ভূখণ্ডের ভেতরের ঘটনা। এর বাইরে সিরিয়া ও ইরাকের মাটিতে ইরান–সম্পর্কিত লক্ষ্যবস্তুতে একের পর এক বিমান হামলা পরিচালনা করে আসছে ইসরায়েল। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানি পতাকাবাহী নৌযানে হামলা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে দেশটি ইরান থেকে জ্বালানি তেল ও অস্ত্রের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ইসরায়েল ইদানীং প্রকাশ্যে কথা বলতে শুরু করেছে। এসব কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধের মধ্যবর্তী প্রচারণা (ক্যাম্পেইন বিটুইন দ্য ওয়ারস) বলছে ইসরায়েল।

সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের নেতারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন। অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করার স্বার্থে তাঁরা আর নিষেধাজ্ঞা চান না। নিদেনপক্ষে নিষেধাজ্ঞা না উঠলেও তা আরও জোরালো হবে না, এমনটাই চাওয়া তেহরানের। এ জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত ইরানি নেতারা। এ বিষয়টি মোসাদ খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে। এমনকি নাতাঞ্জে সাম্প্রতিক হামলার পরও ইরান বলেছে, যথাযথ সময় এলে তবেই কঠোর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। যদিও ১৩ এপ্রিল ওমান উপসাগরে ইসরায়েলি বাণিজ্যিক নৌযানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রেখেছে তেহরান।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

আগেই বলা হয়েছে, ইরানের আপাতত একটাই চাওয়া, অর্থনৈতিক স্বার্থে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার কিংবা সীমিত করা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ইরানের হাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রপ্তানি খাতে পতন দেখা দেওয়ায় গত বছর তা সাকল্যে ৪০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সামনে একটাই পথ খোলা। তা হলো, ভিয়েনা আলোচনা ফলপ্রসূ করা। যেকোনোভাবে নিষেধাজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসা। জুনে ইরানেও সাধারণ নির্বাচন। এরপর সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির উত্তরসূরি ক্ষমতায় বসবেন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা থেকে ইতিবাচক ফল না এলে চলমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে যেতে পারে।

এ বিষয়ে আরেকটি জটিলতা রয়ে যাচ্ছে। সেটা হলো, নির্বাচনের বছরে ইরানের প্রভাবশালী গোষ্ঠীদের মধ্যে রেষারেষি ও দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। গত ২১ মার্চ ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ ‘গান্ডো’–এর দ্বিতীয় মৌসুমের সম্প্রচার শুরু হয়েছে। ধারণা করা হয়, এ সিরিজটি নির্মাণ ও প্রচারে সরাসরি সহায়তা করেছে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড করপস (আইআরজিসি)।

যখন ইসরায়েলের এমনটা করা উচিত, তখন প্রাণঘাতী মহামারি ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আইআরজিসি নিজেই নিজ দেশের সরকারকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গুপ্তচরবৃত্তির কল্পকাহিনি প্রচার করছে।
মোহাম্মদ আলি শাবানি, সম্পাদক, আমওয়াজডটমিডিয়া

এ সিরিজে ইরানের কূটনীতিকদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা দৃশ্যায়ন করা হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জারিফ ও তাঁর দলের কূটনীতিকদের সঙ্গে অভিযুক্তদের ব্যাপক মিল রয়েছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন দৃশ্যায়নের পেছনে আইআরজিসির ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ ইরানিদের অনেকেই। জারিফকে এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হচ্ছিল। যদিও তিনি ভোটের লড়াইয়ে আগ্রহ দেখাননি।

এ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট আমওয়াজডটমিডিয়ার সম্পাদক মোহাম্মদ আলি শাবানি বলেন, যখন ইসরায়েলের এমনটা করা উচিত, তখন প্রাণঘাতী মহামারি ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আইআরজিসি নিজেই নিজ দেশের সরকারকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গুপ্তচরবৃত্তির কল্পকাহিনি প্রচার করছে।


* ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য সাইমুম।