ইসরায়েলি একটি স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে বিশ্বের দেশে দেশে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মার্টফোনে আড়ি পাতার ঘটনা ফাঁস হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানসহ ১৭টি সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
রোববার গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরি করা সফটওয়্যার ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে এই আড়ি পাতার ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, এমনকি কোনো দেশে ক্ষমতাসীন পরিবারের সদস্যদের ওপরও আড়ি পাতা হয়েছে। মূলত, কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর সরকার আড়ি পাতার কাজে এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে।
পেগাসাস হলো একটি ম্যালওয়্যার (বিশেষ ধরনের ভাইরাস)। এর মাধ্যমে আইফোন ও অ্যানড্রয়েড ফোনের সব মেসেজ, ছবি, ই–মেইল, কল রেকর্ড বের করা যায়। এই ম্যালওয়্যার ফোন ব্যবহারকারীর অজ্ঞাতেই মাইক্রোফোন চালু করে দেয়।
৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা ফাঁস হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহকেরা এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে। প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংবাদ সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রথম এ তালিকা হাতে পায়। পরে তা অন্যান্য সংবাদমাধ্যমকে জানায়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গার্নিয়েরি গার্ডিয়ানকে বলেন, একবার কোনো ফোনে (স্মার্টফোন) পেগাসাস সফটওয়্যার ঢুকে গেলে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনের দখল পেয়ে যায়। ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ই–মেইল—সবই দেখতে পাবে, গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালু করতে পারবে। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের মতো এনক্রিপটেড মেসেজিং অ্যাপের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে।
গার্ডিয়ান বলছে, যেসব ফোন নম্বর পাওয়া গেছে, তার সব কটিতেই পেগাসাসের মাধ্যমে আড়ি পাতা হয়েছে বা তা করার চেষ্টা হয়েছে, সে বিষয় এখনো নিশ্চিত নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এনএসওর গ্রাহক বিভিন্ন দেশের সরকার নজরদারির জন্য এসব ফোন নম্বরে বাছাই করেছে।
ফাঁস হওয়া তালিকায় থাকা নম্বর ব্যবহার করা হতো, এমন স্বল্পসংখ্যক কিছু মোবাইল ফোনের ফরেনসিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি ফোনেই পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে নজরদারি চালানো হয়েছে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফাঁস হওয়া তালিকায় কাদের নম্বর রয়েছে, তা ভবিষ্যতে প্রকাশ করা হবে। এই ব্যক্তিদের মধ্যে শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাহী, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, একাডেমিক, এনজিওকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা রয়েছেন। একটি দেশের শাসকের পরিবারের সদস্যদের নম্বরও রয়েছে। তাতে বোঝা যায়, ওই শাসক নিজের স্বজনদের ওপর নজরদারি চালাতে গোয়েন্দাদের নির্দেশ দিয়ে থাকতে পারেন।
রোববার এই তালিকা ফাঁস হতে শুরু করে। প্রথমে তালিকায় ১৮০ জনের বেশি সাংবাদিকের নম্বর থাকার কথা জানা যায়। যাঁদের মধ্যে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, ফ্রান্স ২৪, ইকোনমিস্ট, এপি ও রয়টার্সের প্রতিবেদক, সম্পাদক ও নির্বাহীরাও রয়েছেন।
এ তালিকায় নিহত মেক্সিকান ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সেসিলিও পিনেডা বিরতোর নম্বর রয়েছে। গাড়ি ধোয়ার একটি জায়গায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এ হত্যাকাণ্ডের আগের কিছু দিন তাঁর ওপর নজরদারি চালানো হয়। তবে তাঁর ফোন পাওয়া না যাওয়ায় ফরেনসিক বিশ্লেষণও সম্ভব নয়।
ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও এক বিবৃতিতে বলেছে, তালিকায় যে ৫০ হাজার ফোন নম্বরের কথা বলা হচ্ছে, সেটা ‘অতিরঞ্জিত’। এনএসওর ভাষ্য, এটা গ্রাহকদের পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে নজরদারি করা ফোন নম্বরের তালিকা হতে পারে না। তারা ৪০টি দেশের শুধু সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এ স্পাইওয়্যার বিক্রি করেছে। এটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার আগে ব্যাপকভাবে গ্রাহকদের মানবাধিকার রেকর্ড যাচাই–বাছাই করা হয়েছে।