ইরানের শক্তি ও সম্ভাবনার প্রতীক হয়েছেন জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। ছবি: রয়টার্স
ইরানের শক্তি ও সম্ভাবনার প্রতীক হয়েছেন জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। ছবি: রয়টার্স

এক হত্যায় বদলে যায় অনেক হিসাব

ইরানিদের চোখের মণি ছিলেন জেনারেল সোলাইমানি। দেশটির এলিট বাহিনী ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডসের প্রধান ছিলেন।  মার্কিন হামলায় তাঁর মৃত্যুর জোর বদলা না নিয়ে ইরান ছাড়বে বলে মনে হয় না। হত্যাকাণ্ডের এক বছর পরও সেই আশঙ্কায় আছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিদায়ী বছরের প্রথম তোলপাড় করা ঘটনা সম্ভবত সেই সোলাইমানিকে হত্যা। গত ৩ জানুয়ারি ইরাকের রাজধানী বাগদাদের বিমানবন্দরের কাছে ড্রোন হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। এই আঘাত হজম করা সহজ ছিল না, ইরান তা করেওনি।

তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়ায় ৭ জানুয়ারি ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ধপাধপ ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বসে তেহরান। অবশ্যই সে হামলা মার্কিনদের তরফে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়নি। কিন্তু এই এক হত্যার ঘটনা আরব বিশ্বের অনেক হিসাব–নিকাশ বদলে দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তেহরানের ‘বদলা’ এখনো বাকি রয়েছে বলে সতর্ক মার্কিন কর্মকর্তারা।


সামরিক ক্ষেত্রে ইরানকে একের পর এক সফলতা এনে দেওয়ায় ইরানে সোলাইমানির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। কোটি কোটি ইরানির মণিকোঠায় তাঁর স্থান ছিল ‘নায়ক’ হিসেবে। ইসরায়েলের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হিটলিস্টের প্রথম নামটাই ছিল সোলাইমানির। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিএআইও তাঁকে বধ করে গিয়ে একাধিকবার ব্যর্থ হয়। অবশেষে সফল হয় তারাই।

সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের জেরে ইরান মার্কিন বাহিনীকে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া করার কথা বলে আসছে। সেই পরিকল্পনা থেকে ইরান কাতার, তুরস্কের মতো দেশগুলোকে নিয়ে আঞ্চলিক মিত্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এতে করে সৌদি আরবের সঙ্গে ওই দেশগুলোর সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। আর এটা মধ্যপ্রাচ্যে বিভেদ আরও জটিল করবে।


এর বদলা একদিন বেশ ভালোমতোই ইরান নিতে পারে বলে আশঙ্কা মার্কিনদের। তাই সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের বর্ষপূর্তি যতই এগিয়ে আসছে, তাঁদের মনে ততই বাড়ছে ইরানের প্রতিশোধের শঙ্কা। মধ্যপ্রাচ্যে নিয়োজিত মার্কিন সেনাবাহিনীর বিভাগকে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড বলা হয়। সেই কমান্ডের প্রধান জেনারেল কেনেথ ফ্রাঙ্ক ম্যাককেনজি জুনিয়র সম্প্রতি বলেছেন, ইরানের সরকার অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে চাপে থাকলেও দেশটির নেতারা এখনো বদলার নেশায় মত্ত রয়েছেন। তাঁরা সুযোগ খুঁজছেন। তবে হামলা চালালে তাঁরাও যে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না, সেটাও ইরানিদের মনে করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা কারোরই অজানা নয়। সেটা হোক ইরান বা অন্য কারোর।


এই হুংকার শুধু যে একপক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি থেকে শুরু করে দেশটির সামরিক কমান্ডাররাও অহরহ বলে আসছেন, সোলাইমানির রক্ত বৃথা যাবে না; বৃথা যেতেও দেব না। এসব বক্তব্য যে প্রচ্ছন্ন হুমকি, সেটা কারও কাছেই অস্পষ্ট নয়। এসব পাল্টাপাল্টি হুমকি থেকে বোঝা যায়, দুই দেশের যে কেউ যদি আর একবার ভুল করে বসে, তাহলে বিশ্ব আরেকটি বড় যুদ্ধে পতিত হতে পারে। সেই প্রস্তুতিও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে রেখেছে। ইরাকে মার্কিন সেনাদের রক্ষা করতে ইতিমধ্যে দেশটিতে নতুন আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ম্যাককেনজিও সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, তাঁরা যেকোনো হামলা মোকাবিলায় সদা প্রস্তুত। চলতি মাসেই মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হয়েছে অত্যাধুনিক বোমারু বিমান বি–৫২।

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের আগুনে ঘি ঢালা

মধ্যপ্রাচ্য সব সময়ই বারুদের মতো উত্তপ্ত। আর সেই সংঘাতের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সুন্নি মুসলিম দেশ সৌদি আরব ও শিয়া মুসলিম–অধ্যুষিত ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে দুই দেশের একাধিক পরোক্ষ লড়াইয়ে লিপ্ত। সোলাইমানি হত্যাকাণ্ড সেই সংঘাতের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। সেই আগুন কখন নিভবে, তা সবারই অজানা। তেহরানের সঙ্গে রিয়াদের সেই পরোক্ষ লড়াই অনেক দেশে বিস্তৃত।

বিমানবন্দর থেকে বের হওয়া দুটি গাড়ির একটিতে ছিলেন কাসেম সোলাইমানি। মার্কিন ড্রোনের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে একটি গাড়িতে ঘটে প্রবল বিস্ফোরণ। মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় কাশেম সোলাইমানির।

ইয়েমেন তাদের একটি। যুদ্ধে একেবারে ভেঙে পড়েছে দেশটি। এই যুদ্ধে দেশটির সুন্নি সরকারকে রসদ জোগাচ্ছে সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জোট। আর শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের অস্ত্র–অর্থ–সামরিকসহ নানা সহায়তা দিয়ে আসছে ইরান। ইয়েমেনের রাজধানী অনেক আগেই পতন হয়েছে হুতিদের হাতে। শুধু এডেনসহ কিছু এলাকা নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে সৌদিসমর্থিত সুন্নি সরকার। ইয়েমেনের এই সমরে হুতিদের সফলতার পেছনের কারিগর হিসেবে ভাবা হয় জেনারেল সোলাইমানিকে। ফলে তাঁর হত্যাকাণ্ড হুতিদের মধ্যে দাগ কেটেছে। তারা আরও শক্তি সঞ্চয় করছে ‘শত্রুদের’ ধ্বংস করার জন্য। সরকারি বাহিনীও একচুল ছাড় দিতে রাজি নয়। ফলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হবে। তবে এই যুদ্ধ যে–ই জিতুক না কেন, তাদের হাতে আজীবন লেগে থাকবে ইয়েমেনি শিশু, নারী, বৃদ্ধবনিতার তাজা রক্ত। আর যুদ্ধের সঙ্গে বিশ্ববাসীর মনে দীর্ঘদিন গেঁথে থাকবে খাবারের অভাবে কঙ্কালসার ইয়েমেনি শিশুদের নিস্তেজ দেহ। কানে বাজবে বোমায় হতাহত ব্যক্তির স্বজনদের আর্তনাদ।


শুধু ইয়েমেনেই নয়, সিরিয়া ও লেবাননেও শক্ত প্রভাববলয় গড়ে তুলেছে ইরান। বলা হয়, তেহরানের সহায়তার কারণেই সিরিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল–আসাদ দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোকে পরাজিত করে নিজের পতন ঠেকাতে পেরেছেন। আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা ফ্রি সিরিয়ান আর্মিসহ বিভিন্ন বিদ্রোহীগোষ্ঠীকে প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ সহায়তা দিয়ে আসছে সৌদি আরব। তবে সিরিয়ায় ইরান ও রাশিয়ার প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় এসব বিদ্রোহী তেমন সুবিধা করতে পারেনি। সিরিয়ায় আইএসসহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে ‘পরাজিত’ করার পেছনে সোলাইমানির রণকৌশলকে বাহবা দেওয়া হয়।

সোলাইমানি হত্যাকাণ্ড সিরিয়ার সংঘাতে সামান্য প্রভাব ফেললেও ইরানের প্রতিবেশী ইরাকে এর প্রভাব পড়েছে অনেক বেশি। এটার কারণেই সামনের দিনগুলোতে ইরাক আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার নেশায় এখনো মত্ত রয়েছে ইরাকে শিয়া মিলিশিয়ারা। বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসসহ গ্রিন জোন এলাকায় রকেট হামলা তারই প্রমাণ। ইরাকে সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে তা গৃহযুদ্ধে রূপ নেবে। এতে করে জঙ্গিরা সুবিধা পেতে পারে। আর সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের জেরে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীকে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া করার কথা বলে আসছে। সেই পরিকল্পনা থেকে ইরান কাতার, তুরস্কের মতো দেশগুলোকে নিয়ে আঞ্চলিক মিত্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এতে করে সৌদি আরবের সঙ্গে ওই দেশগুলোর সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। আর এটা মধ্যপ্রাচ্যে বিভেদ আরও প্রকট করবে।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও আন্তর্জাতিক চুক্তি

যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদারের ঘোষণা দেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি।

২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে বিশ্বের ছয় ক্ষমতাধর দেশ। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করা। বিনিময়ে দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। ওই চুক্তিতে ছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ২০১৮ সালে ওই বহুজাতিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। চুক্তিটি ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে ট্রাম্প তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করেন। আর তারই সূত্র ধরে দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে। সোলাইমানি হত্যার পর সেই উত্তেজনায় যুক্ত হয় নতুন পারদ। ওই হত্যাকাণ্ডের পরপরই তেহরান পারমাণবিক কর্মসূচি জোরালো করার ঘোষণা দেয়। পরমাণু সমৃদ্ধকরণের অগ্রগতির তথ্যও জানিয়েছে তেহরান। তবে গত মাসে ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে গুপ্ত হামলা চালিয়ে হত্যার পর ইরান নিজেদের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ আরও বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়াতে ইরান একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে বলেও সম্প্রতি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। পরমাণু চুল্লিগুলোকে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগও নিয়েছে দেশটি।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে হাঁটে, তাহলে সেটা হবে আরেকটি বাকবদলের ঘটনা। এতে করে পশ্চিমা দেশের সঙ্গে ইরানের নতুন করে উত্তেজনা বাড়বে, যা যুদ্ধের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। তবে একটি আশা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন। ইরানের সঙ্গে চুক্তি করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ছিলেন বারাক ওবামা প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ফলে তিনি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এটা করতে তিনি ব্যর্থ হলে নিঃসন্দেহে তার প্রভাব পড়বে দুই দেশের সম্পর্কে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলও চাইবে না ইরানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ুক ওয়াশিংটন। তলে তলে যুদ্ধের উসকানিও থাকবে ইসরায়েলের। এতে করে সম্পর্ক আরও জটিল থেকে জটিল হবে।