ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শহর

ইরানের ক্ষেপনাস্ত্র
ছবি : রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক দিন দিন তিক্ত হয়ে উঠছে। বাড়ছে বড় ধরনের বিরোধের আশঙ্কা। এর মধ্যেই ইরান তাদের ‘ক্ষেপণাস্ত্র শহর’ সারা বিশ্বের সামনে উন্মোচন করেছে। ওই শহরের অবস্থান স্পষ্ট না করলেও সেখানে হাজারো শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র মজুতের বিষয়টি এখন সবার জানা। ইরানের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির নতুন সংঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শহরের একটি ভিডিও চিত্র অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড করপোরেশনের (আইআরসিজি) ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ভিডিওতে ক্ষেপণাস্ত্র শহরে ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের সমারোহ দেখা যায়।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধে ২০১৫ সালে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে একটি মাইলফলক চুক্তি সই হয়। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। কারণ হিসেবে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ওই চুক্তিতে ফাঁক রয়ে গেছে। সেখানে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন বন্ধের কোনো কথা নেই। এরপরই ট্রাম্প ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করা তাঁর অন্যতম প্রধান লক্ষ্যে পরিণত করেন। এ জন্য নতুন অবরোধসহ যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত কূটনৈতিক চাপে ইরান বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে ট্রাম্পের ওই চাপে ইরান তাদের দৃঢ়তা দেখায়। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র দেশটি নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের জানান দিয়ে বুঝিয়ে দেয় তারা যুক্তরাষ্ট্রের চোখরাঙানি উপেক্ষা করতে জানে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের তিক্ত সম্পর্কের মধ্যেই ঘটে যায় দুটি বড় ঘটনা। গত বছরের ৩ জানুয়ারি ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরের বাইরে হামলা চালিয়ে ইরানের প্রভাবশালী সামরিক কমান্ডার জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগীকে হত্যার পর ফুঁসে ওঠে ইরানসহ পশ্চিমাবিরোধী দেশগুলো। এরপর দেশের অন্যতম শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যার ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আঙুল তোলে দেশটি। প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকিও দেয়। ইরানের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর আঘাতের বিপরীতে ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে।
ইরানের ওই ক্ষেপণাস্ত্র শহরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ইরানের সামরিক বাহিনী বলেছে, তাদের এই স্থাপনা ইলেকট্রনিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের সুরক্ষা দেবে। মার্চের শুরুতেই ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়। ইরানের মদদপুষ্ট মিলিশিয়া গ্রুপ দাবি করে, তারা ওয়াশিংটনসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরক্ষা কোষ সক্রিয় করেছে। মিডল ইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী ইরানের প্রতিরক্ষা সেল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেও সক্রিয় হয়েছে।

ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ইরানের বিশেষ বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ডসের উপসাগরীয় অঞ্চলে ভূগর্ভে যে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি উদ্বোধন করেছে, তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিশ্চিত করা হয়নি। রেভল্যুশনারি গার্ডসের প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি বলেন, নৌবাহিনীর কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণের ঘাঁটিগুলোর মধ্যে এটি একটি। সেখানে রাখা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শত শত কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম এবং এর ধ্বংসক্ষমতা অনেক বেশি। শত্রুপক্ষের অত্যাধুনিক যুদ্ধসরঞ্জামকে এড়িয়ে আঘাত হানতে পারে এটি।

গত বছরই রেভল্যুশনারি গার্ডসের পক্ষ থেকে তাদের এই ঘাঁটির তথ্য সামনে আনা হয়। তখনই বলা হয়, ইরান উপসাগরীয় উপকূল বরাবর ভূগর্ভে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। এ ঘাঁটি নিয়ে ইরানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি শত্রুদের জন্য ‘দুঃস্বপ্ন’।

রাষ্ট্রীয় টিভিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ক্ষেপণাস্ত্র শহরের বর্ণনায় বলা হয়েছে, সিমেন্টের দেয়ালসহ একটি ডিপোতে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাজানো রয়েছে। এ ছাড়া রাডার, মনিটরিং, সিমুলেশন এবং অত্যাধুনিক নানা যুদ্ধাস্ত্র সেখানে রয়েছে। গার্ডস কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামির ভাষ্য, ‘আমরা আজ যা দেখছি, তা বিপ্লবী গার্ডের নৌবাহিনীর দুর্দান্ত এবং বিস্তৃত ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতার ক্ষুদ্র একটি অংশ।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক থিওডোর কারাসিক আরব নিউজকে বলেছেন, ইরান কীভাবে তার ভূগর্ভস্থ ঘাঁটি শক্তিশালী করে তুলেছে এবং ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন বৈকল্পিক পরীক্ষা ও নির্মাণও করছে, তা এ শহর দেখিয়ে দিয়েছে।

আলোচনা-সমালোচনা

সৌদি আরবের রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামদান আল শেহরি আরব নিউজকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরানের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং তাতে অংশগ্রহণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখে। নতুন এই ভিডিও চিত্র তাদের সক্ষমতার পরিচয় দেয়। তবে ইরানের এই বাড়াবাড়িতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনো চুপ করে আছে।

ইরানের সামরিক মহড়ার সময় উৎক্ষেপণ করা ক্ষেপণাস্ত্র। ১৬ জানুয়ারি এ ছবি প্রকাশ করেছে দেশটির রেভল্যুশনারি গার্ডসের ওয়েবসাইট সেপাহনিউজ

গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তীব্র উত্তেজনার মধ্যে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস তাদের নতুন নৌ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করে। উপসাগরে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস এবং ওই অঞ্চলে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার উত্তেজনা দেখা দেয়। সামরিক উত্তেজনার জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে দেশ দুটি। গত বছরের জানুয়ারিতে ইরাকের বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। এর জবাবে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। সেই থেকে দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনার পারদ বেড়েই চলেছে।

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্সের ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে সামরিক অস্ত্রের সক্ষমতার দিক থেকে ইরান আছে ১৪ নম্বরে। দেশটির পেছনে আছে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরায়েল (১৮) ও সৌদি আরব (২৫)। সূচকের শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে রাশিয়া ও চীন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড ইউনিটের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের সাবেক পরিচালক কার্ল শুস্টার বলছেন, যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমেই ইরানের এসব প্রতিরক্ষা স্থাপনা ধ্বংস করার চেষ্টা চালাবে। তবে কাজটি সহজসাধ্য নয়। ইরান নিজেই এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে এবং এর সঙ্গে সমন্বিত রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার মিশেল ঘটিয়েছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা

মার্কিন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইরানের অস্ত্রভান্ডারে মূলত স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এক ডজনের বেশি ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র আছে ইরানের। এর মধ্যে কিয়াম-১ নামের ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ৭০০ কিলোমিটারের বেশি। ৭৫০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক এটি বহন করতে পারে। ২০১৭ সালে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল ইরান। অন্যদিকে শাহাব-৩ প্রকৃতিগতভাবে ব্যালিস্টিক মিসাইল, যার পাল্লা দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) বলছে, ইরানের ৫০টির বেশি মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার ও ১০০টির বেশি স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার রয়েছে। সম্প্রতি আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা করায়ত্ত করার চেষ্টা করছে ইরান। এর জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলছে।

২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির প্রাক্কালে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থার উন্নয়নের কাজটি বন্ধ করেছিল ইরান। তবে গবেষণা সংস্থা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট বলছে, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইরান সেই কর্মসূচি ফের শুরু করেছে বলেই তাদের বিশ্বাস। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) বলছে, আকাশে সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওড়া যুদ্ধবিমানেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে সক্ষম ইরান। ২০১৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে ইরান পেয়েছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ‘এসএ-২০ সি’। মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার মতে, আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ইরানের হাতে থাকা সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র এটি।

ইরানের হুমকি

দেশের অন্যতম শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইরান। ইরানের রাজধানী তেহরানের কাছে তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে প্রথমে বোমা হামলা চালানো হয়, এরপর গুলি করা হয়। ফাখরিজাদেহ দামাভান্দ এলাকার অ্যাবসার্দের একটি হাসপাতালে মারা যান। পশ্চিমা বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মোহসেন ফাখরিজাদেহকে ইরানের গোপন পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এ ছাড়া কূটনীতিকেরা প্রায়ই তাঁকে ‘ইরানের বোমার জনক’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর তাঁকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে ইরান বলেছে, ‘প্রতিশোধ অনিবার্য। সোলাইমানির হত্যাকারী ও আদেশদাতাকে অবশ্যই প্রতিশোধের মুখোমুখি হতে হবে।’

বাইডেনের সঙ্গেও উত্তেজনা

২০১৫ সালে বিশ্বের শক্তিশালী ছয়টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত রাখে। ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। ইসরায়েলের বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন আবার ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে আসার কথা বলেছেন। তবে ওই চুক্তি পুনর্জীবিত করতে কার আগে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, তা নিয়ে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তেহরানের শর্ত হচ্ছে, চুক্তি নিয়ে আলোচনার আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জারি করা অবরোধ অবশ্যই তুলে নিতে হবে। অন্যদিকে ওয়াশিংটন বলছে, তেহরানকে আগে চুক্তির শর্তে ফিরতে হবে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ইরানসহ পারমাণবিক চুক্তিতে থাকা ছয় দেশের মধ্যে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ কিন্তু এর মধ্যেই ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র শহর দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কি উসকানি দিয়ে রাখল?