কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে আলোচনা এখন সবখানে। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি দুনিয়ায় এআই ঘিরে নতুন কিছু উদ্ভাবন ও উদ্যোগ সামনে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার প্রধান নির্বাহী ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক দীর্ঘদিন ধরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপদ নিয়ে সতর্ক করে আসছেন। তিনি বলেছেন, পারমাণবিক যুদ্ধের চেয়েও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপজ্জনক হতে পারে। তাঁর অন্যতম উদ্বেগ হচ্ছে, এআই মানবকর্মীর জায়গা নিয়ে নেবে। এ ছাড়া স্কাই নেটের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একসময় সিদ্ধান্ত নেবে, মানুষের আর কোনো প্রয়োজন নেই।
কিন্তু মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সতর্ক করলেও ইলন মাস্কও এই দৌড়ে শামিল হয়েছেন। এর পেছনে অবশ্য বিশেষ কারণ রয়েছে। বর্তমানে আলোচিত মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোগ ওপেনএআইকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চান তিনি।
প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের এআইভিত্তিক নতুন স্টার্টআপের নাম এক্সএআই। তাঁর উদ্যোগের বাজারমূল্য রাতারাতি ব্যাপক বেড়ে গেছে। এমনকি এআই খাতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মূল্যায়ন পাওয়া উদ্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইলন এক্সএআই। সম্প্রতি এক্সএআইয়ের পক্ষ থেকে নতুন করে ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের সিরিজ বি বিনিয়োগ সংগ্রহের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সময় ইলন মাস্কের এ প্রতিষ্ঠানের বাজারমূল্য ধরা হয় ২ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার।
মাস্কের প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগকারীর তালিকায় যুক্ত হয়েছে নামীদামি সব বিনিয়োগকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সিকোইয়া ক্যাপিটালের নাম যেমন আছে, তেমনি অ্যান্দ্রেসেন হরোউইজ, সৌদি আরবের ধনকুবের প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালালের নামও আছে। এর আগে ইলন মাস্কের টুইটার অধিগ্রহণের সময়ও বিনিয়োগ করেছিলেন প্রিন্স আল ওয়ালিদ।
এক্সএআইয়ের বাজারমূল্য বেড়ে যাওয়ায় আলোচিত হচ্ছে জেনারেটিভ এআই। উল্লেখ্য, জেনারেটিভ এআই হলো একধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা কোনো নির্দেশ মেনে জেনারেটিভ মডেল ব্যবহার করে পাঠ্য, ছবি, ভিডিও বা অন্যান্য ডেটা তৈরি করতে সক্ষম। একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা নিয়ে অবশ্য উদ্বেগ রয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এআই–জগতে ইলন মাস্কের পদার্পণের ফলে জেনারেটিভ এআই অস্ত্র প্রতিযোগিতার দৌড় আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এ খাতের শীর্ষে রয়েছে ওপেনএআই। তাদের বর্তমান বাজারমূল্য আট হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
অবশ্য এক্সএআইয়ের এক ঘোষণায় বলা হয়, তারা এ ধাপে যে বিনিয়োগ সংগ্রহ করছে, তা মূলত বিভিন্ন সেবা ও অবকাঠামোতে ব্যয় করবে। এ বিনিয়োগ খরচ করে তারা এক্সএআইয়ের পণ্য বাজারে আনবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগুলোর গবেষণা ও বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে এ অর্থ খরচ করা হবে।
এক্সএআই প্রথমে যে পণ্য তৈরি করেছে, তার প্রধান হচ্ছে গ্রোক। এটি মূলত চ্যাটবট। মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের তৈরি চ্যাটজিপিটির সঙ্গে পাল্লা দিতে নিজস্ব ‘গ্রোক’ চ্যাটবট উন্মুক্ত করেছেন মাস্ক। এটিকে চ্যাটজিপিটির বিদ্রূপাত্মক করে তৈরি করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রোক কি আসলেই অন্য চ্যাটবটের মতোই আরেকটি বট, যা কমান্ড মেনে কাজ করতে পারে, নাকি এটি অন্য কোনো অস্ত্র, যা ওপেনএআইকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তৈরি করা হচ্ছে?
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ওপেনএআই এবং এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) স্যাম অল্টম্যানের দ্রুত এগিয়ে যাওয়া ঠেকাতে গ্রোকের জন্ম হয়েছে, বিষয়টিকে এভাবেও দেখা যেতে পারে। মজার বিষয় হচ্ছে, ওপেনএআইয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে মাস্ক এর সঙ্গেই ছিলেন। পরে তিনি ওপেনএআইকে তাঁর পছন্দের তালিকায় রাখেননি। তিনি প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে গেছেন।
ইলন মাস্ককে ছাড়াই ওপেনএআই যা করেছে, তাকে প্রযুক্তিতে পরবর্তী মহান বিপ্লবের সূত্রপাত বলা হচ্ছে। ইলন মাস্ক তাই এআই পছন্দ করুন বা না করুন, তাঁকে বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিতে হয়েছে। ফলে জন্ম নিয়েছে গ্রোক। ইলন মাস্কের ব্যক্তিগত অপছন্দের স্থান বা ক্ষোভ থেকেই গ্রোকের জন্ম। এতেই গ্রোক বটটি হয়ে উঠেছে ‘বিদ্রূপাত্মক’। একে মূলত চ্যাটজিপিটির ‘কাউন্টার বট’ বা ‘স্পাইটবট’ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
প্রযুক্তি–দুনিয়ায় এআইনির্ভর বটগুলোর প্রতিযোগিতা চলছে। ইলন মাস্ক প্রতিযোগিতায় থাকা অন্য এআইয়ের চেয়ে তাঁর গ্রোক এআইকে আরও মসলাদার করে তৈরি করতে চাইছেন। এক্সএআই চাইছে, ব৵বহারকারীরা যেন গ্রোককে এভাবেই দেখেন এবং আচরণকে মেনে নিতে পারেন। এই এআইকে প্রশিক্ষণে এক্সের (সাবেক টুইটারের) বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
২০২২ সালে বর্তমান এক্স (সাবেক টুইটার) নামের এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি অধিগ্রহণ করেন মাস্ক। টুইটারে নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া এখানে ভুয়া তথ্য ও ঘৃণা বক্তব্যও ব্যাপকভাবে ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। ইলন মাস্ক এ প্ল্যাটফর্মকে অধিগ্রহণের পর থেকে ভুল তথ্য ও ঘৃণামূলক বক্তব্যের সম্পাদনার নীতি শিথিল হয়েছে। তাই গ্রোকের মধ্যে অলীকতত্ত্ব বা ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাস করার বিষয়টি শুরু থেকেই দেখা যেতে পারে।
এআই দুনিয়ায় ওপেনএআই দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। এতে মাস্কের অনুভূতি বুঝতে কোনো এআই প্রয়োজন পড়ে না। গত ফেব্রুয়ারিতে ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্যাম অল্টম্যান ও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ক্যালিফোর্নিয়ায় মামলা করেন মাস্ক। তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক মডেলে যেতে এর মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে। ওপেনএআই এর পণ্যগুলো বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স দিয়ে প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। শুরুতে এটিকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চালু করা হয়েছিল।
ওপেনএআইয়ের সাফল্য নিয়ে তাই মাস্ক জনসমক্ষে সরব। গত মার্চে এক্সে টুইট করে মাস্ক ওপেনএআইয়ের মূল্যায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। যদিও এখনকার তুলনায় তখন এটির বাজারমূল্য পাঁচ হাজার কোটি ডলার কম ছিল। তিনি লেখেন, ‘আমি এখনো বিভ্রান্তিতে আছি, কীভাবে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যাকে আমি ১০ কোটি ডলার দান করেছিলাম, তা কীভাবে ৩ হাজার কোটি ডলার বাজার মূলধন লাভের মতো অবস্থায় পৌঁছেছে? এটা যদি বৈধ হয়, তবে সবাই এ পথে কেন হাঁটে না?
ইলন মাস্ক সম্পর্কে বলা হয়, তিনি পুরোপুরি ব্যবসায়ী। ওপেনএআইয়ে বিনিয়োগের পেছনে মাস্কের একটি স্বার্থ ছিল। ওপেনএআইয়ের বিপক্ষে সরব হলে তাদের পক্ষ থেকে মাস্কের একটি ই–মেলের অংশবিশেষ প্রকাশ করা হয়। তাতে দেখা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে মাস্ক ওপেনএআইকে টেসলার সঙ্গে একীভূত করতে চেয়েছিলেন, যাতে তিনি গুগলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারেন। কিন্তু তাঁর সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এরপরই তিনি ওপেনএআই ছেড়ে দেন।
ইলন মাস্কের চোখে, ওপেনএআইয়ের তৈরি চ্যাটজিপিটি মিথ্যায় ভরা। তিনি ‘ট্রুথজিপিটি’ চান। কিন্তু ৬০০ কোটি ডলারের তহবিল দিয়ে গ্রোকের সক্ষমতা বাড়িয়ে ইলন মাস্ক যা গড়তে চলেছেন, তা কি ট্রুথজিপিটি হবে নাকি ‘স্পাইট জিপিটি’ হবে, তা সময় বলে দেবে।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট