গত কয়েক দশক যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের বেশ রমরমা সময় কেটেছে। প্রতিভা কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি ডলারের মালিক হয়ে গেছেন তাঁরা। কিন্তু ২০২২ সালে এসে তাঁদের হঠাৎই বড় ধাক্কা খেতে হয়েছে। আগে যেভাবে তরতর করে তাঁরা এগোচ্ছিলেন, তা থমকে গেছে। এ বছর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে অনেকের ভবিষ্যৎ বিবর্ণ হতে শুরু করেছে।
মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ, অ্যামাজনের প্রধান জেফ বেজোস তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে হাজারো কর্মী ছাঁটাই করেছেন। আর যে ইলন মাস্ককে একসময়ের অনন্য প্রতিভা মনে করা হতো, তিনি টুইটারের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটিতে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। কর্মী ছাঁটাই, রদবদল, বিতর্কিত নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি এখন ব্যাপক সমালোচনা মুখে পড়েছেন। বায়োটেক প্রতিষ্ঠান থেরানোসের প্রধান নির্বাহী এলিজাবেথ হোমসের তো প্রতারণার দায়ে এক দশকের বেশি কারাদণ্ড হয়েছে! ক্রিপটোকারেন্সি প্রতিষ্ঠান এফটিএক্সের প্রধান স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রায়েডের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা এখন মানুষের মুখে মুখে।
চলুন দেখে আসি, এ বছরে প্রযুক্তি খাতের কয়েকজন সিইও কতটা ক্ষতির মুখে পড়লেন।
মার্ক জাকারবার্গ
একসময়ে তরুণ জাকারবার্গকে বলা হতো অনন্য প্রতিভাধর। ডরমিটরিতে শুরু ফেসবুককে বিশ্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। কিন্তু এত দিন জাকারবার্গকে যে নায়ক হিসেবে দেখা হতো, তা ক্রমেই ফিকে হতে শুরু করেছে। ২০২১ সালে তিনি ফেসবুকের নাম বদলে ফেলার ঘোষণা দেন। তিনি এর নাম দেন মেটা। তিনি ফেসবুকের যুগ থেকে মেটাভার্সের দুনিয়ার দিকে ছুটে চলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। তাঁর এই কাল্পনিক, প্রযুক্তি চশমানির্ভর দুনিয়া এখনো মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়নি। এক বছর পেরিয়ে গেলেও জাকারবার্গ এখনো ভার্চুয়্যাল রিয়ালিটি নিয়ে ঢোল বাজিয়ে চলেছেন, কিন্তু মেটার ভাগ্য ফেরেনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে ভুল কারণে জাকারবার্গের কোম্পানি ইতিহাস গড়ে। এক দিনে মেটার শেয়ারের দাম ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে যায়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি রেকর্ড ছিল। এর ৯ মাস পর জাকারবার্গ স্বীকার করেন, ব্যবসা নিয়ে তাঁর ভাবনা ভুল ছিল। তিনি এর দায়দায়িত্বও নিজ কাঁধে নিয়ে নেন। এর খড়্গ গিয়ে পড়ে কর্মীদের ওপর। ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করে মেটা।
শুধু তা–ই নয়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে মেটার ব্যবহারকারী কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া ফেসবুক এখন পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষের মতো হয়ে গেছে। একসময় যে ফেসবুক মানুষকে টানত, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। তরুণেরা এখন ফেসবুকের বদলে ছুটছেন টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মের দিকে। টিকটকের মতো নানা ফিচার এনে ব্যবহারকারীদের ধরে রাখার চেষ্টাও খুব বেশি কাজে দিচ্ছে না জাকারবার্গের জন্য।
জেফ বেজোস
শুধু জাকারবার্গ নন, অ্যামাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোসকেও এ বছর কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ হাজার কর্মী অ্যামাজন থেকে চাকরি হারাচ্ছেন। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী জেফ বেজোস এ বছর নানা কারণেই খবরের শিরোনাম হয়েছে। তাঁর সাবেক স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি যখন বিশাল দান করে খবরের শিরোনাম হচ্ছিলেন, তখন বেজোস নিজেও চমক দেন। গত নভেম্বরে সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেজোস জীবিত থাকতেই অর্জিত সম্পদের অর্ধেকের বেশি দান করে দেবেন বলে ঘোষণা দেন। বর্তমানে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ, তাঁর আরও সম্পদ থাকে ৬ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। এতে তাঁর জীবনে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলে কথা উঠছে।
বেজোসের মহাকাশ সংস্থা ব্লু অরিজিন মহাকাশ ভ্রমণে সফল হলেও এর ক্রুদের কাছ থেকে খুব ভালো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া মানুষের ঘরে ডিজিটাল পণ্য যুক্ত করার যে পরিকল্পনা নিয়ে বেজোস এগোচ্ছেন, তাতেও বাধা পড়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই বলছেন, অ্যামাজনের ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট সফটওয়্যার অ্যালেক্সা পুরোপুরি সফল নয়। এ ছাড়া বেজোসের জন্য বিব্রতকর বেশ কিছু ঘটনা তাঁকে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকা থেকেও পেছনে ঠেলে দিয়েছে।
ইলন মাস্ক
এ বছরের এপ্রিলে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ছিলেন গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার সিইও ইলন মাস্ক। সম্প্রতি তিনি দুয়ে নেমে গেছেন। ইলন মাস্ক সম্পর্কে সমালোচকেরা বলে থাকেন, তিনি কথা, কাজ ও এর ফলাফলের মধ্যে কোনো সম্পর্ক বোঝেন না। এটা বারবার তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। গত এপ্রিলে টুইটার কেনার প্রস্তাব তারই একটি উদাহরণ। তিনি শেয়ারপ্রতি ৫৪ দশমিক ২০ মার্কিন ডলারে টুইটার কেনার প্রস্তাব দেন। টুইটার এ প্রস্তাবে রাজি হলে ইলন মাস্ক পেছাতে শুরু করেন। কিন্তু আইনি লড়াইয়ে নেমে তিনি টুইটার কিনতে বাধ্য হন।
টুইটারের মালিক হওয়ার পর তিনি একে ‘টুইটার ২.০’ করার ঘোষণা দেন। শুরুতেই ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই করে শোরগোল ফেলে দেন। এরপর কর্মীদের বাড়তি কাজের চাপ দেন। টুইটারে ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট ফেরত দেন। ইলন মাস্ককে নিয়ে কথা বলায় সাংবাদিকদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া টুইটার ঘিরে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে তিনি আলোচনায় রয়েছেন। কিন্তু এতে তাঁর টেসলার শেয়ারের দাম কমে গেছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনীর স্থান হারিয়েছেন তিনি।
পরাগ আগারওয়াল
এ বছরের শুরুতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রযুক্তি সিইও হিসেবে পরাগ আগারওয়ালের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হিসেবে দেখা হচ্ছিল। টুইটারের দায়িত্ব পাওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদের সমর্থনও ছিল তাঁর পক্ষে। এরপরই টুইটারে আসেন ইলন মাস্ক। শুরুতে দুজনের সম্পর্ক আন্তরিক ছিল। কিন্তু টুইটার কেনার পর ইলন মাস্কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। টুইটারে বট বা ভুয়া অ্যাকাউন্ট নিয়ে ইলন মাস্ক তদন্ত করতে চাইলে পরাগ আগরওয়ালের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নষ্ট হয়। মাস্ক দায়িত্ব নিয়েই পরাগকে বরখাস্ত করেন। পরাগ চাকরি হারালেও টুইটার থেকে পাঁচ কোটি মার্কিন ডলার পাবেন।
এলিজাবেথ হোমস
শুরুটা হয়েছিল ২০০৩ সালে। ওই সময় একটি স্টার্টআপ বায়োটেক প্রতিষ্ঠান খোলেন এলিজাবেথ হোমস। তিনি স্ট্যানফোর্ডের লেখাপড়া ছেড়ে দেন। এরপর টানা দুই দশক ধরে তিনি ওই প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এ বছরের শুরুতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। এলিজাবেথ হোমস রক্ত পরীক্ষা করার সিস্টেম উদ্ভাবনের নামে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে যান বিনিয়োগকারীরা। প্রতারণার অভিযোগে ১১ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তার।
স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রায়েড
ক্রিপটোকারেন্সি বা ভার্চ্যুয়াল মুদ্রার দুনিয়ায় স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রায়েড পরিচিত নাম। তাঁর ক্রিপটোকারেন্সি বিনিময় প্রতিষ্ঠান এফটিএক্স কয়েক মাস আগেও বিশ্বের শীর্ষে ছিল। সুপার বোলে বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রচার–প্রচারণায় এগিয়ে ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠান। কিন্তু গত নভেম্বরে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ভরাডুবি দেখেছে বিশ্ব। এক সপ্তাহ পরেই স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রায়েড বাহামাসে আটক হন। প্রসিকিউটররা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতারণার ঘটনা ঘটিয়েছেন ব্যাংকম্যান-ফ্রায়েড।
তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান, রয়টার্স, এএফপি