জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারের মালিকানা কিনে নিয়েছেন বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার কর্ণধার তিনি। সফল এই ব্যবসায়ী টুইটারকে লাভজনক করতে এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। মাস্কের মালিকানায় টুইটারে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে ১১ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস।
গত ২৮ অক্টোবরের ঘটনা। আগের রাতে ইলন মাস্ক টুইটার কেনার চুক্তি করেন। ৪৪ বিলয়ন ডলারের ওই চুক্তির মাধ্যমে টুইটারের মালিক হন তিনি। এর কয়েক ঘণ্টা পরে সান ফ্রান্সিসকো শহরে টুইটারের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন মাস্ক। সেখানে ব্যাপক পরিসরে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রস্তুতি নিতে বলেন তিনি। মাস্ক বলেন, অবিলম্বে টুইটারের কর্মীর সংখ্যা কমাতে হবে। আর যাঁরা ছাঁটাই হবেন, তাঁদের ১ নভেম্বর যে বোনাস দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হবে না। ওই আলোচনা সম্পর্কে অবগত ছয়জন ব্যক্তি এ তথ্য জানিয়েছেন।
মানবসম্পদ বিভাগের নির্বাহীরা টুইটারের নতুন মালিককে সতর্ক করে বলেন, তাঁর এ পরিকল্পনা শ্রম আইনের লঙ্ঘন এবং কর্মীদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হতে পারে। ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা মামলাও করতে পারেন। তখন মাস্কের উপদেষ্টারা জানান, মাস্কের আদালতে যাওয়ার এবং জরিমানা দেওয়ার অভ্যাস আছে। আর এসব ঝুঁকি নিয়ে তিনি চিন্তিতও নন। তখন টুইটারের মানবসম্পদ, হিসাব ও আইন বিভাগ মাস্কের নির্দেশনা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত তিনজন ব্যক্তি জানিয়েছেন, ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা মামলা করলে সেগুলো পরিচালনা ও জরিমানা বাবদ কত খরচ হতে পারে, সে বিষয়ে দুই দিন পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে জেনে নেন ইলন মাস্ক। কোন কোন কর্মীকে ছাঁটাই করা হবে, তা নিয়ে টুইটারের ব্যবস্থাপকদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় এই প্রক্রিয়া শুরু করতে দেরি হয়। এরপরেই ইলন মাস্ক সিদ্ধান্ত নেন, ১ নভেম্বর পর্যন্ত কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়টি স্থগিত থাকবে।
মাস্ক টুইটার কেনার পরের দুই সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটিতে কী ধরনের বিশৃঙ্খলা চলেছে, তা বোঝা যায় তাঁর অবিলম্বে কর্মী ছাঁটাইয়ের নির্দেশ, এতে কর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া আতঙ্ক এবং কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার মধ্য দিয়ে। টুইটার কীভাবে চলা উচিত, তা নিয়ে ৫১ বছর বয়সী ইলন মাস্কের মাথায় অনেক ধরনের চিন্তাভাবনাই ছিল। তবে এসব পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এতে মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বৈশ্বিক একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত টুইটার নিয়ে ব্যবসায়িক, আইনি, আর্থিকসহ নানা জটিলতায় পড়ে যান মাস্ক।
টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পরাগ আগরওয়াল এবং প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) নেড সেগাল যখন জানতে পারেন ইলন মাস্কের সঙ্গে যে চুক্তি হওয়ার কথা, তা বিকেলে সম্পন্ন হচ্ছে, তখনই তাঁরা অফিস থেকে বেরিয়ে যান।
টুইটারের বর্তমান ও সাবেক কর্মী মিলিয়ে ৩৬ জন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তি এবং টুইটারের অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ও প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের মধ্যে হওয়া আলাপচারিতা থেকে বোঝা যায়, বিরূপ এই পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নির্বাহী কর্মকর্তাকে ই–মেইলে চাকরিচ্যুতির কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক শ কর্মীকে ছাঁটাই করতে বলার পর প্রকৌশল বিভাগের একজন ব্যবস্থাপক বমি করে ফেলেন। তা ছাড়া মাস্কের নির্দেশনা পূরণের লক্ষ্যে কঠোর সময়সূচি মেনে কাজ করতে গিয়ে কর্মীদের কেউ কেউ টুইটার কার্যালয়ে ঘুমিয়েও রাত পার করেছেন।
টুইটার এমনিতেই কিছুদিন ধরে আর্থিক চাপের মুখে ছিল। এর মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থাও ভালো যাচ্ছে না। তবে এরপরও এক মাস আগে টুইটার যে রকম ছিল, এখনকার টুইটারের সঙ্গে সেই টুইটারের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। গত সপ্তাহে ইলন মাস্ক টুইটারের ৭ হাজার ৫০০ জন কর্মীর মধ্যে অর্ধেককে ছাঁটাই করেছেন। নির্বাহী কর্মকর্তাদের পদত্যাগও অব্যাহত আছে। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচন ঘিরে টুইটারে গুজবও ছড়িয়েছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার মাধ্যমে আয় করার যে পরিকল্পনা মাস্ক করেছেন, সেটাও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিছু বিজ্ঞাপনদাতাও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
যাঁরা কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন তাঁদের জন্য টুইটার একটি ভালো জায়গা। আর যাঁরা এটা করতে পারেন না, তাঁরা জেনে রাখুন, টুইটার আপনাদের জন্য নয়।ইলন মাস্ক
ইলন মাস্ক বৃহস্পতিবারের বৈঠকে টুইটারের কর্মীদের বলেছিলেন, টুইটারের অবস্থা শোচনীয়। এরপর অবশ্য এ নিয়ে তাঁর মন্তব্য চেয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে তিনি কোনো সাড়া দেননি।
নিউইয়র্ক টাইমসের হাতে আসা ওই বৈঠকের একটি রেকর্ডে ইলন মাস্ককে বলতে শোনা যায়, ‘নগদ আয় ব্যাপকভাবে কমেছে এবং টুইটারের দেউলিয়া হওয়ার বিষয়টিও খারিজ করে দেওয়া যায় না।’
সেদিন কর্মীদের মাস্ক আরও বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখার জন্য তাঁদের নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে। তিনি বলেন, ‘যাঁরা কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন ও জেতার জন্য খেলেন, তাঁদের জন্য টুইটার একটি ভালো জায়গা। আর যাঁরা এটা করতে পারেন না, তাঁরা জেনে রাখুন, টুইটার আপনাদের জন্য নয়।’
গত ২৬ অক্টোবর টুইটারের সান ফ্রান্সিসকো কার্যালয়ে যান ইলন মাস্ক। তিনি একটি সাদা রঙের ‘সিংক’ হাতে কাচের দরজা ঠেলে ভবনে ঢোকেন। এ সময় মাস্ক টুইট করেন, ‘লেট দ্যাট সিংক ইন।’ টুইটে জুড়ে দেন তাঁর ভবনে ঢোকার সময়কার একটি ভিডিও।
টুইটারের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা লেসলি বারল্যান্ড এ সময় ইলন মাস্ককে স্বাগত জানাতে কর্মীদের উৎসাহ দেন এবং তিনি ইলন মাস্ককে সঙ্গে করে টুইটার কার্যালয়ে নিয়ে যান। এ সময় প্রতিষ্ঠানের কফি বারে কর্মীদের সঙ্গে ইলন মাস্ককে কথা বলতেও দেখা যায়।
এরপর চিত্রটি দ্রুত বদলে যায়। এ ঘটনা সম্পর্ক অবগত এমন দুই ব্যক্তি জানান, পরদিনই টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পরাগ আগরওয়াল এবং প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) নেড সেগাল অফিসে ছিলেন। বিকেলে তাঁরা যখন জানতে পারেন টুইটারের মালিক হতে ইলন মাস্কের সঙ্গে যে চুক্তি হওয়ার কথা, তা বিকেলে সম্পন্ন হচ্ছে, তখনই তাঁরা অফিস থেকে বেরিয়ে যান। নতুন মালিক কী করবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন তাঁরা।
২৮ অক্টোবর টুইটারের মানবসম্পদ বিভাগের নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠকে মাস্ক সরাসরি বলেন, অবিলম্বে তিনি কর্মী ছাঁটাই করতে চান। আর এটা তিনি করতে চান ১ নভেম্বরের আগেই। কারণ, ওই দিন টুইটারের কর্মীদের বিশেষ একটি বোনাস দেওয়ার কথা ছিল।
এর কিছুক্ষণ পর পরাগ আগরওয়াল ও নেড সেগাল ই–মেইল পান। ই–মেইলে বলা হয়, তাঁদের বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে টুইটারের আইন ও নীতিবিষয়ক প্রধান নির্বাহী বিজয়া গাড্ডে এবং টুইটারের জেনারেল কাউন্সেল শন এডগেটকেও চাকরিচ্যুত করা হয়। এডগেট এ সময় টুইটারের কার্যালয়ে ছিলেন। তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়।
ওই দিন সন্ধ্যায় টুইটার কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ‘ট্রিক অর টুইট’ নামে একটি হ্যালোইন পার্টির আয়োজন করে। এতে কিছু কর্মী বাহারি পোশাক পরে উৎসবের আমেজ তৈরির চেষ্টা করেন। আর অন্য কর্মীরা কান্নাকাটি এবং পরস্পরকে আলিঙ্গন করে একে অপরকে সান্ত্বনা দেন।
ওই পার্টিতে মাস্ক তাঁর কয়েকজন উপদেষ্টাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, যাঁদের মধ্যে অনেকেই মাস্কের প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পেপাল ও বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার মতো তাঁর অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাঁরা টুইটারের সদর দপ্তরের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ‘ওয়ার রুমে’ সমবেত হয়েছিলেন। ওই স্থানটি টুইটার তাদের প্ল্যাটফর্মে বড় বড় বিজ্ঞাপনদাতা এবং বিশিষ্টজনদের সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকে। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিও রয়েছে।
ওই পার্টিতে যেসব বিজ্ঞাপনদাতা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ডেভিড স্যাকস, জেসন কালাকানিস ও শ্রীরাম কৃষ্ণান; ইলন মাস্কের ব্যক্তিগত আইনজীবী অ্যালেক্স স্পিরো, তাঁর আর্থিক ব্যবস্থাপক জারেড বিরশাল এবং টেসলার সাবেক পরিচালক আন্তোনিও গ্রেসিয়াস। আরও ছিলেন টেসলার প্রকৌশলী ও অন্যরা, মাস্কের মস্তিষ্কবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিউরালিংক এবং টানেল কোম্পানি দ্য বোরিং কোম্পানির কর্মীরা। এ সময় মাস্কের সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই বছর বয়সী ছেলে।
২৮ অক্টোবর টুইটারের মানবসম্পদ বিভাগের নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠকে মাস্ক সরাসরি বলেন, অবিলম্বে তিনি টুইটারের কর্মী ছাঁটাই করতে চান। আর এটা তিনি করতে চান ১ নভেম্বরের আগেই। কারণ, ওই দিন টুইটারের কর্মীদের বিশেষ একটি বোনাস দেওয়ার কথা ছিল।
এরপর টুইটারের একটি দল কাজ শুরু করে কর্মী ছাঁটাই বাবদ কত খরচ হবে তা নিয়ে। আরেকটি দলের দায়িত্ব পড়ে কর্মী ছাঁটাই করা হলে মাস্ককে আইনি প্রক্রিয়ায় কী পরিমাণ ফি ও জরিমানা গুনতে হতে পারে, তা বের করার।
এরপরে গত ৩০ অক্টোবর মাস্ককে জানানো হয়, তিনি যদি এভাবে হুটহাট করে কর্মীদের ছাঁটাই করেন, তাহলে তাঁকে কয়েক মিলিয়ন ডলার গুনতে হতে পারে। যে অঙ্ক নির্ধারিত বোনাসসহ কর্মীদের ছাঁটাই করলে যে খরচ হবে, তার চেয়ে বেশি হবে। এ কথা শুনে কর্মী ছাঁটাই পিছিয়ে দেন ইলন মাস্ক।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁর একটা শর্ত ছিল। বোনাস দেওয়ার আগে মাস্ক এ নিয়ে একটি নিরীক্ষা করতে বলেন। টুইটার কর্মীরা ‘সত্যিকার মানুষ’ কি না, সেটা যাচাই করে দেখতে বলেন তিনি। মাস্ক বলেন, ‘ভুতুড়ে কর্মীদের’ অর্থ দেওয়া উচিত হবে না।
নিউইয়র্ক টাইমসের হাতে আসা টুইটারের অভ্যন্তরীণ নথি এবং ঘটনা সম্পর্কে জানেন এমন তিন ব্যক্তি বলেছেন, টুইটারের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা রবার্ট কেইডেনকে এই নিরীক্ষা চালাতে বলেন ইলন মাস্ক। কেইডেন তখন ব্যবস্থাপকদের যাচাই করতে বলেন যে, তাঁরা টুইটারের নির্দিষ্ট কিছু কর্মীকে চেনেন এবং নিশ্চিত করতে পারবেন যে তাঁরা মানুষ।
এর মধ্যে ১ নভেম্বর বোনাস দেওয়ার দিন আসে এবং বড় ধরনের কোনো কর্মী ছাঁটাই ছাড়া–ই দিনটি পার হয়। পরদিন কেইডেনকে বরখাস্ত করা হয়। টুইটার কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যান তিনি।
এত দিন বিশেষ পরিচিতি আছে এমন বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের অ্যাকাউন্টে বিনা মূল্যে নীল টিক দিত টুইটার। মাস্ক এই সেবা নতুন আঙ্গিকে নিয়ে আসতে চাইছেন, যাতে মাসে আট ডলারের বিনিময়ে গ্রাহককে বিশেষ ফিচার ও নীল টিক দেওয়া হবে।
টুইটারের ব্যবস্থাপকেরা যখন কর্মীদের মধ্যে কাদের ছাঁটাই করা হবে, সে তালিকা গুছিয়ে আনেন, সে সময় বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য নিউইয়র্কে ছুটে যান ইলন মাস্ক। এসব বিজ্ঞাপনদাতার কাছ থেকেই টুইটারের আয়ের বড় অংশ আসে।
বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে কয়েকটি বৈঠকে মাস্ক এমন একটি পদ্ধতির প্রস্তাব দেন, যেখানে টুইটার ব্যবহারকারীরা বিশেষ একটি ব্যবস্থায় তাঁদের সামনে যেসব কনটেন্ট আসবে, সেগুলো পছন্দ করতে পারবেন। এতে করে বিভিন্ন ব্র্যান্ড নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীদের কাছে নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন দিতে পারবেন। এতে বিজ্ঞাপনদাতাদের সুবিধা হবে। একইসঙ্গে মাস্ক টুইটার ব্যবহারকারী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য আরও সুনির্দিষ্ট সেবা নিশ্চিতের কথা বলেন।
কিন্তু নিউইয়র্কভিত্তিক টুইটারের দুই নির্বাহী বারল্যান্ড ও জেপি মাহেউ টুইটার ছেড়ে চলে যাওয়ায় মাস্কের এই প্রস্তাব আগায়নি। দুজনই বিজ্ঞাপনদাতাদের মহলে সুপরিচিত ছিলেন।
বিজ্ঞাপন বিভাগে দীর্ঘদিন নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করা ল্যু পাসকালিস বলেছেন, টুইটারের এই দুই নির্বাহীর সঙ্গে ‘ফরচুন ৫০০’ তালিকায় (যুক্তরাষ্ট্রের ফরচুন ম্যাগাজিনের করা শীর্ষ করপোরেশনগুলোর তালিকা) থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তারা খুবই স্বচ্ছ এবং সবাইকে নিয়ে কাজ বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁদের বরখাস্ত করাটা টুইটারে আস্থার বিষয়টিকে ঝুঁকিতে ফেলে এবং এ নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে।
ভক্সওয়াগন, জেনারেল মোটরস ও ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আপাতত টুইটারে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ রাখবে। মাস্কের মালিকানায় টুইটার কেমন হবে, তা পর্যালোচনা করছে তারা।
টুইটারের কর্মী ছাঁটাই ধারাবাহিকভাবে করার লক্ষ্য ছিল। টুইটারের ব্যবস্থাপকদের প্রাথমিকভাবে ২৫ শতাংশ কর্মীকে ছাঁটাইয়ের কথা বলা হয়েছিল। কিন্ত টেসলার যেসব প্রকৌশলী টুইটারের কোড পর্যালোচনা করেন তাঁরা প্রকৌশলী দল থেকে আরও বেশি কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রস্তাব দেন।
ইলন মাস্ক টুইটারের কিছু ব্যবস্থাপককে বড় দায়িত্বে নিয়ে এসেছেন। তিনি এস্থার ক্রফোর্ডকে (টুইটারের একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার) টুইটারে নতুন চালু করা টুইটার ব্লু নামের সাবস্ক্রিপশন সেবা দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন। মাস্ক টুইটারের এই সেবা নতুন আঙ্গিকে নিয়ে আসতে চাইছেন, যাতে মাসে আট ডলারের বিনিময়ে গ্রাহককে বিশেষ ফিচার ও নীল টিক দেওয়া হবে। এত দিন বিশেষ পরিচিতি আছে এমন বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের অ্যাকাউন্টে বিনা মূল্যে নীল টিক দিত টুইটার।
এ সেবা নিয়ে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন ইলন মাস্ক। তাঁর নির্দেশ, ৭ নভেম্বরের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে হবে, নাহলে তাঁদের সবাইকে বরখাস্ত করা হবে।
গত সপ্তাহে ক্রফোর্ড টুইটারে একটি ছবি পোস্ট করেন। তাতে দেখা যায়, টুইটারের সান ফ্রান্সিসকো কার্যালয়ে চোখে মাস্ক পরে একটি স্লিপিং ব্যাগে ঘুমাচ্ছেন তিনি। স্লিপ হোয়ার ইউ ওয়ার্ক (যেখানে কাজ করেন সেখানেই ঘুমান) হ্যাশট্যাগ দিয়ে এই টুইট করেন তিনি। টুইটারের কিছু কর্মী ক্রফোর্ডের এ টুইটকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁরা এটা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন, কেন তাঁরা এমন একজন ব্যক্তির অধীনে দীর্ঘ সময় অফিসের কাজ করবেন যে ব্যক্তি যেকোনো সময় তাঁদের বরখাস্ত করতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে টুইটারের সহকর্মীদের মধ্যে আদান–প্রদান হওয়া এসব বার্তা নিউইয়র্ক টাইমস দেখেছে এবং ঘটনাটি সম্পর্কে জানেন এমন পাঁচজন ব্যক্তি তা নিশ্চিত করেছেন।
টুইটারের কর্মী ছাঁটাই ধারাবাহিকভাবে করার লক্ষ্য ছিল। টুইটারের ব্যবস্থাপকদের প্রাথমিকভাবে ২৫ শতাংশ কর্মীকে ছাঁটাইয়ের কথা বলা হয়েছিল। কিন্ত টেসলার যেসব প্রকৌশলী টুইটারের কোড পর্যালোচনা করেন তাঁরা প্রকৌশলী দল থেকে আরও বেশি কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রস্তাব দেন। টুইটারের অন্য বিষয়গুলো যেসব নির্বাহী দেখছিলেন, তাঁদেরও ছাঁটাইয়ের তালিকা আরও বড় করতে বলা হয়েছিল।
এ ছাড়া টুইটারের নির্বাহীরাও সেই তালিকা এমনভাবে মূল্যায়ন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে করে ভারসাম্যহীনভাবে শুধু নির্দিষ্ট বর্ণের (মূলত কৃষ্ণাঙ্গ) কর্মীদের ছাঁটাই করে আইনি কোনো ঝুঁকির মধ্যে পড়তে না হয়। কিন্তু ইলন মাস্কের হয়ে যাঁরা এই কাজ করছিলেন, তাঁরা এ পরামর্শ একেবারে পাত্তাই দিতে চাননি।
২ নভেম্বর টুইটারের কর্মীরা অবসর সময়ে নিজেদের মধ্যে বার্তা আদান–প্রদান করেন এমন একটি মাধ্যমে কিছু বার্তা দেখে হোঁচট খেয়েছিলেন। কারণ, সেখানে টুইটারের মানবসম্পদ বিভাগ এবং আইনি বিষয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা কর্মী ছাঁটাই নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এমন একটি বার্তা দেখেছে নিউইয়র্ক টাইমস। সেখানে একজন কর্মী বলছেন, টুইটারের ৩ হাজার ৭৩৮ জন কর্মী অর্থাৎ মোট কর্মীর অর্ধেককে ছাঁটাই করা হতে পারে। ছাঁটাইয়ের এ বার্তা টুইটার কর্মীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন রাতে ইলন মাস্ক কিছু বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে বিজ্ঞাপন কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসেন। ওই বৈঠকে টুইটারের মানবসম্পদ বিভাগ ও মাস্কের অন্য কোম্পানির কর্মীরাও ছিলেন।
এরপর ছাঁটাই হতে যাচ্ছেন ধরে নিয়ে টুইটারের কর্মীরা একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিতে শুরু করেন। তাঁরা একে অপরের মুঠোফোন নম্বর বিনিময় এবং লিংকডইনে যুক্ত হতে শুরু করেন।
দ্রুতই মাস্কের উপদেষ্টারা বুঝতে পারেন, কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রভাব হবে অনেক বেশি। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ছাঁটাই করা প্রকৌশলী, ডিজাইনার ও প্রোডাক্ট ম্যানেজারদের আবার কাজে ফিরতে বলেন।
প্রকৌশল বিভাগের একজন ব্যবস্থাপক মাস্কের উপদেষ্টাদের মুখোমুখি হন। এ সময় ছাঁটাইয়ের তালিকায় কয়েক শ কর্মীর নাম দেখে বমি করে দেন তিনি। পরদিন ৩ নভেম্বর টুইটারের কর্মীরা একটি ই–মেইল পান। স্বাক্ষরের স্থানে টুইটার লেখা ওই ই–মেইলে বলা হয়েছিল, ‘টুইটারকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে নেওয়ার জন্য আমরা বিশ্বজুড়ে কর্মী কমানোর একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাব।’
এরপরই শুরু হয় বিপর্যয়কর ও বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতি। যদিও আগের মেইলে বলা হয়েছিল, চাকরি আছে কি না, এ সম্পর্কে কর্মীরা পরদিন সকালে নতুন একটি ই–মেইল পাবেন। কিন্তু অনেকে দেখেন, তাঁদের ই–মেইল অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বার্তা আদান–প্রদানের গ্রুপেও তাঁরা আর নেই। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় এসব কর্মীর আর চাকরি নেই। এদিকে যারা অভ্যন্তরীণ বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ স্ল্যাকে ছিলেন তাঁরা সবাই সহকর্মীদের বিদায় দিতে বিদায়ী সালামের মতো ইমো পোস্ট করতে শুরু করেন।
এদিন ছাঁটাই করা কর্মীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। টুইটারের প্ল্যাটফর্ম দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইউনিট রেডবার্ড থেকে অনেক ব্যবস্থাপককে সরিয়ে দেন ইলন মাস্ক। ওই বিভাগের প্রকৌশলী দলের প্রায় ৮০ শতাংশকে ছাঁটাই করা হয়। একসঙ্গে এতজন কর্মী ছাঁটাই করায় টুইটার সচল রাখা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়।
এ ছাড়া ব্লুবার্ড নামে টুইটারের কনজ্যুমার বিভাগের কয়েক ডজন প্রোডাক্ট ম্যানেজারকেও ছাঁটাই করা হয়। এতে করে ওই বিভাগে অবশিষ্ট থাকেন মাত্র এক ডজন পণ্য ব্যবস্থাপক। একটি আনুমানিক হিসাবে, এভাবে ছাঁটাইয়ের পরে ওই বিভাগে প্রতি ৭০ জন প্রকৌশলীর বিপরীতে মাত্র একজন পণ্য ব্যবস্থাপক থাকেন।
টুইটারে এভাবে কর্মী ছাঁটাই হওয়ার বিষয়টি জানাজানির পর প্রযুক্তি খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সেই সুযোগকে কাজে লাগায়। টুইটারের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান মেটা (ফেসবুক) ও গুগলের শীর্ষস্থানীয় ব্যবস্থাপকেরা টুইটারের বেশ কয়েকজন কর্মীকে প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে আসতে বার্তা পাঠান।
এই পুরো প্রক্রিয়াতেই মাস্কের অধস্তনরা ছিলেন একেবারে নিশ্চুপ। কিন্তু ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট কালাকানিস টুইটারে উদ্বেগ জানিয়ে আসছিলেন। ঘটনাটি সম্পর্কে জানেন, এমন চারজন ব্যক্তি বলেন, দ্রুতই মাস্কের উপদেষ্টারা বুঝতে পারেন, কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রভাব হবে অনেক বেশি। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ছাঁটাই করা প্রকৌশলী, ডিজাইনার ও প্রোডাক্ট ম্যানেজারদের আবার কাজে ফিরতে বলেন।
টুইটারের রাজস্ব বিভাগ গোল্ডবার্ডে ছাঁটাই হওয়া এমন কর্মীদের আবার ফিরিয়ে আনতে হয়। ওই কর্মীরা প্রতিষ্ঠানের আয়ের জন্য প্রধান প্রধান যেসব পণ্য আছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করতেন এবং তাঁদের ওই কাজ তাঁরা ছাড়া আর কেউ করতে পারতেন না। এরপর টুইটারের কিছু কর্মী কাজে ফিরে দেখেন, কিছু কিছু বিষয়ের ওপর তাঁরা নির্ভরশীল ছিলেন সেগুলো আর কাজ করছে না। সান ফ্রান্সিসকোতে একজন প্রকৌশলী দেখেন, ভেন্ডরদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ব্যবহারকারীদের তথ্য–উপাত্ত ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব সফটওয়্যার দেওয়ার কথা, সেগুলো বন্ধ হয়ে আছে অথবা এসবের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এবং যেসব ব্যবস্থাপক বা নির্বাহী এসব সমস্যা সমাধান করতে পারতেন তাঁরা হয় ছাঁটাই হয়েছেন নয়তো চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। এদিকে টুইটারের নিউইয়র্ক কার্যালয়ের কর্মীরা ওয়াই–ফাই ব্যবহার করতে পারছেন না। কারণ, যে কক্ষে সার্ভার রাখা থাকে, সেটি বেশি গরম হয়ে গেছে এবং ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
অনুবাদ: আল-আমিন সজীব