সবচেয়ে শক্তিশালী ১০ ভূমিকম্প কবে ও কোথায় হয়েছিল

ব্যাপক প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভূমিকম্প। দেশে দেশে বিভিন্ন সময় শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি হয়েছে। সময় গড়িয়ে গেছে, তবে কোনো কোনো ভূমিকম্পের প্রভাব রয়ে গেছে প্রজন্মান্তরে। একনজরে দেখে নেওয়া যাক, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী (রিখটার স্কেলের মাত্রা অনুযায়ী) ১০টি ভূমিকম্প কবে ও কোথায় হয়েছে—

ভালদিভিয়া ভূমিকম্প

ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন চিলির ভালদিভিয়া শহরের বাসিন্দারা। ১৯৬০ সালের ৩১ মে তোলা
ছবি: এপি

এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘গ্রেট চিলিয়ান ভূমিকম্প’ নামেও পরিচিত। ১৯৬০ সালের ২২ মে বিকেলে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির ভালদিভিয়া শহরে আঘাত হানে এই ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৯ দশমিক ৫। এই ভূমিকম্পের পর শক্তিশালী সুনামি আছড়ে পড়ে চিলির উপকূলে। এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পাশে হাওয়াই উপকূল, জাপান ও ফিলিপাইনের উপকূলীয় এলাকায় সুনামির আঘাত লাগে। ভালদিভিয়া ভূমিকম্পে কতজন মারা গেছেন, সেটা নিশ্চিত নয়। বলা হয়, নিহত হওয়ার সংখ্যা সর্বোচ্চ ছয় হাজার। আরও হাজার তিনেক মানুষ আহত হন।

গ্রেট আলাস্কা ভূমিকম্প

১৯৬৪ সালে ভূমিকম্পে ভেঙে যায় আলাস্কার পথ

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় আঘাত হানা এই ভূমিকম্পকে ‘গুড ফ্রাইডে ভূমিকম্প’ নামেও ডাকা হয়। ১৯৬৪ সালের ২৭ মার্চ গুড ফ্রাইডের বিকেলে আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ড অঞ্চলে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। তীব্রতা ছিল ৯ দশমিক ২। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প এটা।
ভূমিকম্পের পর ২৭ ফুট উঁচু সুনামি উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। এই ভূমিকম্প ও সুনামিতে ১৩৯ জনের মৃত্যুর খবর জানা যায়। তার মধ্যে শুধু ভূমিকম্পে নিহত হন ১৫ জন।

সুমাত্রা ভূমিকম্প

ভূমিকম্প ও সুনামির ধ্বংসস্তূপের সামনে বসে আছেন এক ব্যক্তি। ১৩ জানুয়ারি ২০০৫, ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচেহ

ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক দুর্যোগ এটা। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরে ভূকম্পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৯ দশমিক ১। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের পশ্চিম উপকূলের কাছে ছিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। তাই এটিকে সুমাত্রা ভূমিকম্প নামে ডাকা হয়।
ভূমিকম্পের পর উপকূলীয় এলাকায় ১০০ ফুট উঁচু সুনামি আছড়ে পড়ে। এটা ভারত মহাসাগর সুনামি, দক্ষিণ এশিয়ান সুনামি, ইন্দোনেশিয়ান সুনামি, ক্রিসমাস সুনামি—এমন নানা নামে পরিচিত। ভূমিকম্প ও সুনামিতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

তোহোকু ভূমিকম্প

সুনামিতে ফুলেফেঁপে সাগরের পানি লোকালয়ে ঢুকছে। ১১ মার্চ ২০১১, জাপানের মিয়াগি প্রদেশের নাতোরি শহরে

জাপানের উপকূলঘেঁষা প্রশান্ত মহাসাগরে ২০১১ সালের ১১ মার্চ আঘাত হানে এই ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৯ দশমিক ১। ভূমিকম্পের পর জাপানের ভূখণ্ডে প্রলয়ংকরী সুনামি আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাস উঠেছিল ১৩৩ ফুট উঁচুতে। এমনকি জাপানের উপকূল থেকে ১০ কিলোমিটার ভেতরেও সুনামির ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকে পড়ে।
ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী দুর্যোগ বিবেচনা করা হয় এটাকে। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ জাপান সরকার জানায়, ওই ভূমিকম্প ও সুনামিতে ১৫ হাজার ৮৯৪ জন নিহত ও ৬ হাজার ১৫২ জন আহত হয়েছিলেন। নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা ২ হাজার ৫৬২। ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ জাপানের ব্যাপক অবকাঠোমোগত ক্ষতি হয় এই দুর্যোগে।

ক্যামচাটকা ভূমিকম্প

১৯৫২ সালের ৪ নভেম্বর রাশিয়ার দূরবর্তী পূর্বাঞ্চলের ক্যামচাটকা উপদ্বীপে আঘাত হেনেছিল এই ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৯। ভূমিকম্পের পর প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল ঢেউ সুনামি হয়ে আছড়ে পড়েছিল উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর। ৫০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় জনপদ। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ক্যামচাটকা উপদ্বীপ ও কুরিল দ্বীপে। ভূমিকম্প আর সুনামিতে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার মানুষ নিহত হন।

মাউলি ভূমিকম্প

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির মধ্যাঞ্চলীয় মাউলির উপকূলীয় এলাকায় ২০১০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আঘাত হানে ভূমিকম্পটি। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৮ দশমিক ৮। ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপকূলীয় শহর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। সুনামিতে প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় চিলির তালচাউয়ানো বন্দর। এই ভূমিকম্প ও সুনামিতে নিহত হন ৫২৫ জন। পরের বছরের জানুয়ারিতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিখোঁজ ছিলেন আরও অন্তত ২৫ জন।

ইকুয়েডর-কলম্বিয়া ভূমিকম্প

দক্ষিণ আমেরিকার দুই দেশ ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ায় ১৯০৬ সালের ৩১ জানুয়ারি আঘাত হানে এই ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮। ভূমিকম্পে দুই দেশেই ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়। নিহত হন প্রায় এক হাজার মানুষ। আরও অনেকে আহত ও বাস্তুচ্যুত হন।

র‍্যাট আইল্যান্ডস ভূমিকম্প

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের র‍্যাট আইল্যান্ডসে ১৯৬৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আঘাত হানে শক্তিশালী এই ভূমিকম্প। এর তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭। ওই অঞ্চলটিতে জনবসতি খুবই সীমিত। সেই কারণে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পরও হতাহতের ঘটনা ছিল নগণ্য। আলাস্কা পেরিয়ে হাওয়াই ও ক্যালিফোর্নিয়ায় আঘাত হেনেছিল সুনামি।

আসাম-তিব্বত ভূমিকম্প

১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসাম-তিব্বতে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়

ভারতের আসাম ও পার্শ্ববর্তী তিব্বতে এই শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। তারিখটা ছিল ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট। তিব্বতের সীমান্তঘেঁষা রিমা অঞ্চল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। রিখটার স্কেলে তীব্রতা ছিল ৮ দশমিক ৬। এই ভূমিকম্পে ওই অঞ্চলে দেড় থেকে তিন হাজার মানুষ নিহত হন। বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভূমিকম্পের কারণে ভূমিধসে স্থানীয় সোবণশিরি নদীর গতিপথ আটকে যায়। আট দিন পর ভেঙে পড়ে সেখানকার বাঁধ। প্লাবিত হয় অসংখ্য গ্রাম। এতে নিহত হন ৫৩৬ জন। এই ভূমিকম্পের কারণে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন।

ভারত মহাসাগর ভূমিকম্প

ইন্দোনেশিয়ার আচেহ শহরসংলগ্ন ভারত মহাসাগরে ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল আঘাত হেনেছিল শক্তিশালী ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৮ দশমিক ৬। ইতিহাসে এটা ভারত মহাসাগর ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ভূমিকম্পের পরপর কর্তৃপক্ষ সুনামি সতর্কতা জারি করলেও কিছু সময় পর তা তুলে নেওয়া হয়। এই ভূমিকম্পে ১০ জন নিহত এবং আরও ১২ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ মারা যান আতঙ্কিত কিংবা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে।

তথ্যসূত্র: ব্রিটানিকা ও জিওলজিসায়েন্স