বিশ্বের সবচেয়ে দামি ১০ চিত্রকর্ম

আবেগ প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম চিত্রকর্ম। চিত্রকর্মে একটি গল্প বা ঐতিহ্যকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। মানবসংস্কৃতির শুরু থেকেই তাই চিত্রকর্ম মূল্যবান এক মাধ্যম। তবে শুধু শৈল্পিক মান আর নান্দনিক গুণাবলির জন্যই নয়, বরং লোকে বিনিয়োগ করার এবং উচ্চ সামাজিক অবস্থান প্রকাশের প্রতীক হিসেবেও চিত্রকর্মের মূল্য দেয়। তাই কোনো কোনো চিত্রকর্মের মূল্য ছোটখাটো দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) চেয়ে বেশি হয়। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ১০ চিত্রকর্মের গল্প তুলে ধরা হলো:

সালভাতর মুন্দি

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা সালভাতর মুন্দি ছবিটি দেখছেন দুই দর্শনার্থী
ফাইল ছবি: এএফপি

অনেকেই মনে করেন, লেওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ‘মোনালিসা’ বিশ্বের সবচেয়ে দামি চিত্রকর্ম। এটির আনুমানিক মূল্য ধরা হয় ৯৭ কোটি মার্কিন ডলার। ১৮০৪ সাল থেকে ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামের জিম্মায় আছে। ‘ফ্রেঞ্চ হেরিটেজ ল’ দ্বারা এটি সুরক্ষিত। ফলে এটির কেনাবেচা নিষিদ্ধ।

‘মোনালিসা’ কেনাবেচা নিষিদ্ধ হলেও লেওনার্দো দা ভিঞ্চিরই আরেকটি চিত্রকর্ম এখন পর্যন্ত নিলামে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। সেটি হলো ‘সালভাতর মুন্দি’ বা বিশ্বের রক্ষাকর্তা। ১৪৯৯ থেকে ১৫১০ সালের মধ্যে কোনো একসময় ছবিটি আঁকা হয়। নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে নিউইয়র্কে ক্রিস্টি নিলাম হাউসের একটি নিলামে এটি ৪৫ কোটি মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়। সৌদি আরবের প্রিন্স বদর বিন আবদুল্লাহ বিন মোহাম্মদ বিন ফারহান আল-সৌদ সেটি কিনে নেন। ছবিতে যিশুখ্রিষ্টকে বিশ্বের রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে।

ইন্টারচেঞ্জ

নেদারল্যান্ডস বংশোদ্ভূত মার্কিন চিত্রশিল্পী উইলেম দা কুনিংকে ‘শিল্পীদের শিল্পী’ বলা হয়। তিনি অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য বিমূর্ত ধারাকে বেছে নিয়েছেন। তাঁর ছবিতে মানুষ, ভূপ্রকৃতি ও নির্জীব বস্তু দেখা যায়। তাঁর আঁকা ‘ইন্টারচেঞ্জ’-এ একজন নারী পেছনের কোলাহল অগ্রাহ্য করে শুয়ে আছেন। ২০১৫ সালে ডেভিড গেফেন ফাউন্ডেশন থেকে এই তেলচিত্র ৩০ কোটি মার্কিন ডলারে কিনে নেন দ্য হেজ ফান্ডের সিইও কেনেথ সি গ্রিফিন।

দ্য কার্ড প্লেয়ার্স

ফ্রান্সের চিত্রশিল্পী পল শেজাঁ ১৮৯০–এর দশকে শ্রমিকদের তাস খেলা নিয়ে পরপর পাঁচটি ছবি আঁকেন। তার একটি এটি

ফ্রান্সের চিত্রশিল্পী পল শেজাঁ ১৮৯০-এর দশকে পরপর পাঁচটি ছবি আঁকেন। সেগুলোয় শ্রমিকদের তাস খেলতে দেখা যায়। ‘দ্য কার্ড প্লেয়ার্স’-এ দুজন শ্রমিককে মগ্ন হয়ে তাস খেলতে দেখা যায়। পল শেজাঁর চিত্রকর্মগুলো অনেক বেশি নাটুকে ও রঙিন। সেই তুলনায় ‘দ্য কার্ড প্লেয়ার্স’ অনেক বেশি শান্ত। পল শেজাঁর পাঁচটি ছবি বিশ্বজুড়ে নানা জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয়েছে। ২০১১ সালে কাতারের রাজপরিবার ২৫ কোটি ডলারে ‘দ্য কার্ড প্লেয়ার্স’ চিত্রকর্ম কিনে নেয়।

নাফেয়া ফা ইপো ইপো

‘নাফেয়া ফা ইপো ইপো’ চিত্রকর্মটি প্রদর্শনীর জন্য ঝোলাচ্ছেন জাদুঘরের কর্মীরা

‘নাফেয়া ফা ইপো ইপো’ একটি তাহিতিয়ান বাক্যাংশ। এর বাংলা অর্থ ‘কবে বিয়ে করছ?’ ফরাসি শিল্পী পল গগাঁ ১৮৯১ সালে প্রথমবার ফরাসি দ্বীপ তাহিতি ভ্রমণ করেন। সে সময় প্রথম দিকে আঁকা তাঁর ছবিগুলোর একটি ‘নাফেয়া ফা ইপো ইপো’। ছবিতে এক মা ও তাঁর তরুণী মেয়েকে দেখা যায়। ছবিটির মালিক ছিলেন সুইজারল্যান্ডের ধনকুবের রুডলফ স্টেচেলিন। পরে তিনি তাঁর একজন কাতারি ক্রেতার কাছে সেটি ৩০ কোটি ডলারে বিক্রি করে দেন। যদিও ২০১৭ সালে এক মামলায় দেখা যায়, সেটি ২১ কোটি ডলারে বিক্রি করা হয়েছিল।

নাম্বার সেভেনটিনএ

‘নাম্বার সেভেনটিনএ’ একটি বিমূর্ত ছবি, চিত্রকর্মটি এঁকেছেন জ্যাকসন পোলক। ফাইবার বোর্ড ক্যানভাসে এটি আঁকা। দ্য হেজ ফান্ডের সিইও কেনেথ সি গ্রিফিন ২০১৫ সালে ডেভিড গেফেন ফাউন্ডেশন থেকে ছবিটি ২০ কোটি মার্কিন ডলারে কিনে নেন।

দ্য স্ট্যান্ডার্ড বিয়ারার

‘দ্য স্ট্যান্ডার্ড বিয়ারার’ ১৬৩৬ সালে আঁকা। নেদারল্যান্ডসের স্বর্ণযুগের শিল্পী রেমব্রান্ট ফন রিজনের আঁকা এই ছবিতে এক সেনাসদস্যকে দেখা যায়। এটিকে তাঁর নিজের প্রতিকৃতিও বলা হয়।

চিত্রকর্মটি একসময় ব্রিটিশ রাজা কিং জর্জের (চতুর্থ) সংগ্রহে ছিল। ১৮৪৪ সালে রথসচাইল্ড পরিবার সেটির মালিকানা ফিরে পায়। ২০২১ সালের শেষ দিকে নেদারল্যান্ডস সরকার রথসচাইল্ড পরিবারের কাছ থেকে ছবিটি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং পরের বছর ১৭ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারে সেটি কিনে নেয়।

নাম্বার সিক্স (ভায়োলেট, গ্রিন অ্যান্ড রেড)

ছবিটি ১৯৫১ সালে রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন চিত্রশিল্পী মার্ক রথকোর আঁকা। এটি একটি বিমূর্ত ছবি। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ধনকুবের দিমিত্রি রাইবোলোভলেভ ১৮ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারে ‘নাম্বার সিক্স (no. 6) (ভায়োলেট, গ্রিন অ্যান্ড রেড)’ কিনে নেন।

ভাসের্সলাঙ্গেন ২

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় একটি মিউজিয়ামে গুস্তাভ ক্লিমতের আঁকা ‘ভাসের্সলাঙ্গেন ২’ দেখছেন দর্শনার্থীরা

এটি অস্ট্রীয় চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্‌টের অসাধারণ এক সৃষ্টি। তেলচিত্রটি আঁকা হয় ১৯০৪ থেকে ১৯০৭ সালের মধ্যে। ক্যানভাসে আঁকা ছবিটি যৌনতা এবং নারীদেহের প্রতি ক্লিম্‌টের মুগ্ধতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেখানে পরাবাস্তব জলজ দৃশ্য ফুটে উঠছে। কয়েক হাত বদলের পর ২০১৭ সাল এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি চিত্রকর্মটি ১৮ কোটি ৩৮ লাখ মার্কিন ডলারে কিনে নেন।

পেনডেন্ট পোর্ট্রেটস অব মার্টিন সুলমানস অ্যান্ড উপেন কপিট

১৬৩৪ সালে আঁকা এই ছবিতে দামি পোশাক ও সাজসজ্জায় নবদম্পতি মার্টিন সুলমান ও উপেন কপিটকে দেখা যাচ্ছে। ছবিতে শিল্পী আলো ও ছায়া নিয়ে তাঁর খেলার সক্ষমতার পরীক্ষা করেছেন। ১৮৭৮ সাল থেকে এটি রথসচাইল্ড পরিবারের মালিকানায় ছিল। পরে আমস্টারডাম  রিকসমিউজিয়াম এবং প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়াম সেটি ১৮ কোটি মার্কিন ডলারে কিনে নেয়।

লে ফেম দা আলগার (ভার্সন ০) বা ‘দ্য উইমেন অব আলজিয়ার্স’(ভার্সন ০)’

পাবলো পিকাসোর ‘দ্য উইমেন অব আলজিয়ার্স’(ভার্সন ০)’

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাসে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ ছবির একটি পাবলো পিকাসোর আঁকা লে ফেম দা আলগার (ভার্সন ০) বা ‘দ্য উইমেন অব আলজিয়ার্স’(ভার্সন ০)’। ১৯৫৫ সালে ছবিটি আঁকা হয়। ছবিতে আলজেরিয়ায় উপপত্নীদের তাঁদের হারেমে একটি হুক্কায় হাশিশ বা আফিম খেতে দেখা যাচ্ছে। ২০১৫ সালে কাতারের রাজপরিবার ১৭ কোটি ৯৪ লাখ ডলারে ছবিটি কিনে নেয়।

তথ্যসূত্র: ফোর্বস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে