গুজরাট দাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্রের ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই নির্দেশের পর ভারতের বিরোধী দলগুলো প্রচারে বিষয়টিকে হাতিয়ার করছে। কেন একটি তথ্যচিত্রের ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। বিজেপির নেতা–কর্মীরা অবশ্য মনে করছেন, এর ফলে লাভবান হবে বিজেপিই।
ভারতের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, গত শুক্রবার ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার এবং ইউটিউবকে নির্দেশ দেয়, বিবিসির তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া: দ্যা মোদি কোশ্চেন’ সরিয়ে দিতে। ২০২১ এর তথ্যপ্রযুক্তি আইনে চিত্রটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার নির্দেশ দেয় ভারত সরকার। নির্দেশ মেনে টুইটার এবং ইউটিউব তথ্যচিত্রের সূত্রগুলো মুছেও ফেলে। রোববার থেকেই ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে।
কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা জয়রাম রমেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বাজনাদারেরা বলছেন, তাঁর ওপর করা বিবিসির তথ্যচিত্রটিতে কুৎসা করা হয়েছে। ছবিটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, প্রধানমন্ত্রী (অটলবিহারী) বাজপেয়ি তবে ২০০২ সালেই কেন চেয়েছিলেন যে উনি (নরেন্দ্র মোদি) দায়িত্ব থেকে সরে যান? শেষ পর্যন্ত অবশ্য (লালকৃষ্ণ) আদবানি পদত্যাগের হুমকি দিলে চাপে পড়ে যান বাজপেয়ী। কিন্তু সে সময়ে কেন বাজপেয়ী তাঁকে (মোদিকে) রাজধর্ম পালন করার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন?’ লালকৃষ্ণ আদবানি সে সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এবং নরেন্দ্র মোদি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী।
মন্তব্যের সঙ্গে জয়রাম রমেশ ইউটিউবে পাওয়া যায় এমন একটি ভিডিও জুড়ে দিয়েছেন। প্রায় এক মিনিটের এই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সাংবাদিকদের বলছেন, ‘রাজধর্ম একটি সার্থক শব্দ। আমি সেই ধর্ম পালন করার চেষ্টা করছি মাত্র। রাজা বা শাসক এক প্রজার সঙ্গে অন্য প্রজার ভেদ করতে পারেন না। জন্ম, জাতি বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে এই বিভেদে একজন রাজার বৈষম্য করা উচিত নয়।’ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বাজপেয়ী যখন এই মন্তব্য করছেন, তখন তাঁর পাশে বসে মৃদু হাসছেন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অথচ এখানে খোলাখুলিভাবে বাজপেয়ী মোদির সমালোচনা করছেন। এই ভিডিও চিত্র তুলে ধরে রমেশ বলতে চেয়েছেন, গুজরাট দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা না থাকলে বাজপেয়ী এই মন্তব্য করতেন না।
তবে বিরোধীরা যা–ই বলুন, টুইটার এবং ইউটিউবে বিবিসির তথ্যচিত্রটির সূত্র কেউ ‘পোস্ট’ করলেই, তা সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলছে ওই দুই সংস্থা। তারা পুরোপুরি ভারত সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করছে বলে সরকারি সূত্র প্রচারমাধ্যমকে জানিয়েছে। যাঁরা তথ্যচিত্রটিকে ‘পোস্ট’ করেছিলেন এবং যা টুইটার মুছে দিয়েছে, তেমন একজন হলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ডেরেক ও'ব্রায়েন।
ডেরেক ও'ব্রায়েন লিখেছেন, ‘সেন্সরশিপ। বিবিসির তথ্যচিত্র আমার টুইটে ছিল, টুইটার তা সরিয়ে দিয়েছে। এটি লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেছেন। এক ঘণ্টার তথ্যচিত্র তুলে ধরেছে প্রধানমন্ত্রী কী পর্যায়ে সংখ্যালঘুদের ঘৃণা করেন।’
তবে শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নন, ভারতসহ গোটা বিশ্বে বিবিসির তথ্যচিত্র প্রবল আলোড়ন এবং বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁরা কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন। নরেন্দ্র মোদির পক্ষের মানুষ যেমন রয়েছেন, তেমন বিপক্ষেও রয়েছেন অজস্র মানুষ। বিশ্বের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী থেকে শিক্ষাবিদ, ঐতিহাসিক, লেখক, শিল্পী, আইনজীবীরা নতুন করে মুখ খুলেছেন ২০০২ সালের দাঙ্গার বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদির পক্ষের লোকেদের বক্তব্য, ভারতের সর্বোচ্চ আদালত প্রধানমন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্য ২০২৪ সালের নির্বাচনে কোনো না কোনো উপায়ে তাঁকে হারানো।
আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে এই বিতর্ক আরও তীব্র আকার ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, আগামীকাল বিবিসি-দুই চ্যানেলে ‘ইন্ডিয়া: দ্যা মোদি কোশ্চেন’-এর দ্বিতীয় পর্ব দেখানো হবে। এই পর্বে ২০১৪ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি ভারতে কী করেছেন বা করেননি তা তুলে ধরা হবে বলে ওই তথ্যচিত্রের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
বিজেপির নেতা–কর্মীদের একাংশ অবশ্য মনে করছেন, বিবিসির তথ্যচিত্র এবং সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণের ফলে আগামী দিনে তাঁর এবং তাঁর দলের সুবিধাই হবে। তাঁরা মানুষকে বলতে এবং বোঝাতে পারবেন যে বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে হারাতে চেষ্টা করছেন বিরোধীরা।