বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ও সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে কয়েক দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিংয়ে দেখা যাচ্ছে। গত রোববার সমতলের শিলিগুড়িতে তাঁকে একটি সমাজসেবামূলক কর্মসূচিতে অংশ নিতেও দেখা যায়। তিনি স্থানীয় গণমাধ্যমে বলেছেন, ভবিষ্যতে শিলিগুড়িসহ পাহাড়ি অঞ্চলের উন্নতি, শিলিগুড়িকে ‘স্মার্ট সিটি’ করা এবং সামগ্রিকভাবে ওই অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাপনের মানোন্নয়ন করাই তাঁর লক্ষ্য।
শ্রিংলার ছবি দিয়ে দার্জিলিংয়ে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টারও সাঁটা হয়েছে, যেখানে তিনি স্থানীয় মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি শিলিগুড়ির কলেজ ময়দানে গণসংযোগ অনুষ্ঠান করেছেন।
স্থানীয় বিজেপি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, দার্জিলিং আসনে আগামী লোকসভা নির্বাচনে ভারতের প্রথম সারির এই কূটনীতিককে দাঁড় করাতে চাইছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। সুতরাং ধরে নেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং আসন থেকে লোকসভায় বিজেপির প্রার্থী হতে যাচ্ছেন শ্রিংলা।
আর এখানেই লেগেছে বিপত্তি। দার্জিলিং আসনে বিজেপির বর্তমান নেতৃত্বের একাংশ এই অঘোষিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিজেপির স্থানীয় নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছে, দার্জিলিং আসন থেকে বর্তমান বিজেপি দলীয় সংসদ সদস্য রাজু বিষ্ঠাই দার্জিলিংয়ে প্রার্থী হওয়ার সব যোগ্যতা রাখেন।
গত রোববার শিলিগুড়িতে শ্রিংলার কর্মসূচির পর সেখানকার বিজেপি এমএলএ শঙ্কর ঘোষ (যিনি একসময় সিপিআইএমের বড় নেতা ছিলেন) গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমার এলাকায় কোনো কর্মসূচি সম্পর্কে আমি জানি না। তিনি (শ্রীংলা) যে এখানকার মানুষ, জি-২০ সম্মেলনের আগে সেটাই জানতাম না। আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এখানকার বর্তমান সংসদ সদস্য রাজু বিষ্ঠা বেশ ভালো কাজ করছেন।’
কার্শিয়াংয়ের বিজেপি এমএলএ বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মাও গণমাধ্যমকে বলেন, দার্জিলিংয়ে সেখানকার বাসিন্দাকেই প্রার্থী করতে হবে। বছরের পর বছর বহিরাগতদের পাহাড়ে এনে প্রার্থী করা হচ্ছে। তাঁরা জেতার পর আর পাহাড়ের দিকে মুখও ফেরান না। এটা যেন একটা খেলার মাঠ হয়ে গেছে।
হর্ষবর্ধন শ্রিংলার পারিবারিক শিকড় এই অঞ্চলে হলেও তিনি দার্জিলিংয়ে বসবাস করেননি। ভারতের উচ্চপদস্থ পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিনিধি হওয়ার সুবাদে তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বা ভারতেরও বাইরে। তাঁর বাবা সিকিমের বৌদ্ধ হলেও তিনি নিজে জন্মেছেন মুম্বাইয়ে এবং পড়াশোনা করেছেন রাজস্থানের আজমির ও দিল্লিতে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক বিএসএম (বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার) ডেস্কের যুগ্ম সচিব শ্রিংলার দ্রুত উত্থান হয় গত ১৫ বছরে। ভারতের রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, যেভাবে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর কূটনীতিক হিসেবে অবসর নেওয়ার পর রাজনীতিতে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন, ঠিক সেই একই মানচিত্র অনুসরণ করে রাজনীতিতে আসছেন শ্রিংলা।
শ্রিংলা নিজে এখনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। শুধু উত্তরবঙ্গের একটি সংবাদপত্রের প্রতিনিধির প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘১৯৬০ সাল থেকে শিলিগুড়ির প্রধান নগরে আমার বাড়ি রয়েছে।’ এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি বহিরাগত প্রার্থী নন, তিনি একজন ভূমিপুত্রই। তাঁর এই মন্তব্য থেকে এই জল্পনা আরও জোরালো হয়েছে, বর্তমান সংসদ সদস্য রাজু বিষ্ঠার জায়গায় দার্জিলিং থেকে প্রার্থী হচ্ছেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।
হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে লিখেছেন, শিলিগুড়ি করিডর কীভাবে পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের প্রধান সেতু হয়ে উঠতে পারে, সেই পরিকল্পনা করতে হবে। এই করিডরের সামরিক গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই জানেন।
বিজেপি ও ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের একটা অংশ কয়েক বছর ধরেই দার্জিলিংসহ পূর্ব বাংলাকে পৃথক রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে গঠনের পক্ষে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছে। তাদের প্রধান যুক্তি, পূর্ব হিমালয়ের এই অংশের ঠিক ওপরে রয়েছে ভুটানের ডোকলাম। সেখানে চীনের প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণকে ভারত ঠেকাতে পারছে না।
ডোকলাম অঞ্চলটি শিলিগুড়ির ‘চিকেন নেক করিডর’ থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার ওপরে; অর্থাৎ যাবতীয় ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে। এই অঞ্চলের দৈর্ঘ্যও ২০ কিলোমিটারের বেশি নয়। এই অঞ্চল দিয়েই উত্তর-পূর্ব ভারতে যাবতীয় পণ্য পরিবহন হয়। অঞ্চলটি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হলে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি মানুষ ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।
এই অবস্থায় শিলিগুড়ি, দার্জিলিং প্রভৃতি অঞ্চলে নিরাপত্তা অবকাঠামো জোরদার করা প্রয়োজন। এ জন্য ভূকৌশলগত রাজনীতি, কূটনীতি ও ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন কাউকে এই অঞ্চলে লোকসভার সদস্য করতে চাইছে বিজেপির নেতৃত্ব। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার মনোনয়ন ঠেকাতে পারবে কি না, তা নিয়ে দার্জিলিংয়ের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সন্দেহ রয়েছে।