স্কুলপড়ুয়াদের দাঙ্গা পড়ানো অর্থহীন। ওই বয়সের ছেলেমেয়েদের দাঙ্গা, হিংসা, খুনাখুনির মতো এমন কিছু পড়ানো উচিত নয় যা তাদের মনে ঘৃণার জন্ম দেয়। তাই দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচি থেকে অযোধ্যা অধ্যায়ের বহু সত্য ও তথ্য বাদ দেওয়া হয়েছে।
ভারতের ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং’ (এনসিইআরটি) দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নতুন যে পাঠ্যসূচি প্রকাশ করেছে, তাতে অযোধ্যা আন্দোলন ও বাবরি মসজিদের ইতিহাসের খোলনলচে বদলে দেওয়া হয়েছে। এতটাই যে ওই পাঠ্যসূচিতে বাবরি মসজিদের নামটাই রাখা হয়নি। এখন তার পরিচিতি ‘তিন গম্বুজঅলা সৌধ’।
এনসিইআরটির পরিচালক দীনেশ প্রসাদ সাকলানি এই পরিবর্তন সমর্থন করেছেন। পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, দেশে দাঙ্গার অভাব নেই। তাই বিশেষ একটি দাঙ্গার কাহিনি পাঠ্যসূচিতে রাখার কোনো যৌক্তিকতাও নেই। তা ছাড়া, শিক্ষার উদ্দেশ্য পড়ুয়াদের মনে ঘৃণার জন্ম দেওয়া নয়। বড় হয়ে যা এমনিতেই জানা যায়, তা স্কুলের পাঠ্যসূচিতে রাখা অর্থহীন। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস পড়ানোর উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন করা। যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি পর্ব তৈরি করা নয়।
এনসিইআরটি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা। তারা বিভিন্ন শ্রেণির স্কুলপড়ুয়াদের পাঠ্যসূচি তৈরি করে। প্রধানত সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই) এই পাঠ্যসূচি অনুসরণ করে। ২০১৪ সালের পর দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে এ নিয়ে চতুর্থবার সংশোধন করা হলো সূচির। নতুন সংশোধিত পাঠ্যপুস্তিকায় অযোধ্যার ঘটনাবলি দুই পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। গত বছরের পাঠ্যপুস্তিকায় যা ছিল চার পৃষ্ঠাজুড়ে। এই কাটছাঁটের ফলে বাদ গেছে লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে বিজেপির সোমনাথ থেকে অযোধ্যা রথযাত্রা, বাবরি মসজিদ ধ্বংসে করসেবকদের ভূমিকা, দেশজুড়ে দাঙ্গা, উত্তর প্রদেশে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি, সেই রাজ্যের তৎকালীন কল্যাণ সিং সরকারকে আদালতের ভর্ৎসনা, অটল বিহারী বাজপেয়ীর সেই অনুশোচনাভরা বিবৃতি, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘অযোধ্যা কাণ্ড বিজেপির সবচেয়ে বড় ভুল’। বাদ দেওয়া হয়েছে ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুটি ছবিও যা সে সময়কার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু তা–ই নয়, নতুন বইয়ে ‘বাবরি মসজিদ’ নামটাই রাখা হয়নি। তার পরিচয় এখন ‘তিন গম্বুজঅলা সৌধ’ যা ‘১৫২৮ সালে তৈরি হয়েছিল। সেটাই ভগবান রামচন্দ্রের জন্মস্থল। তার দেয়ালজুড়ে ছিল হিন্দুধর্মের নানা প্রতীক ও নিদর্শন’।
অথচ আগের বছরের বইয়ে লেখা ছিল, ষোড়শ শতকে মির বাঁকি বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। নতুন বইয়ে তার বদলে লেখা হয়েছে, ‘১৯৮৬ সালে তিন গম্বুজঅলা স্থাপত্যের তালা খোলার পর কিছু মানুষকে প্রার্থনার অনুমতি দেয় ফৈজাবাদ আদালত। তখন হিন্দুরা অবহেলিত বোধ করেছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন যে রামের জন্মভূমি ও শ্রীরামকে নিয়ে তাঁদের আবেগ গুরুত্ব পায়নি। অন্যদিকে মুসলমানেরা চেয়েছিলেন, ওই স্থাপত্যের ওপর তাঁদের অধিকার কায়েম করতে।’
নতুন বইয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের রায়ের বিস্তারিত উল্লেখ করে নতুন বইয়ে লেখা হয়েছে, ওই রায়ের ফলে রামমন্দির তৈরি হয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়কে দেওয়া হয়েছে মসজিদ তৈরির আলাদা জমি। স্পর্শকাতর একটি বিষয়ের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা কীভাবে করা যায়, সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় তার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
শিক্ষায় ‘গৈরিকীকরণের’ অভিযোগ নস্যাৎ করে দীনেশ প্রসাদ সাকলানি বলেছেন, ‘গৈরিকীকরণের অভিযোগ কেন উঠছে বুঝি না। পাঠ্যপুস্তকে তো ১৯৮৪ সালের শিখ দাঙ্গার কথা নেই। তা হলে? তা নিয়ে তো কোনো হইচই নেই? সারা পৃথিবীতেই পাঠ্যসূচির বদল হয়। অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বাদ যায়। আমরা নেতিবাচক নাগরিক তৈরি করতে চাই না। ইতিবাচক মানুষ গড়তে চাই। পাঠ্যসূচির উদ্দেশ্যও তা।’