নির্বাচনী প্রচার পর্বে যে গুঞ্জন পল্লবিত হয়েছিল, তা যে নিছক গুজব ছিল না, তা বুঝিয়ে দিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত। সরকার গঠনের পরদিন এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত সেবকের অহংকারী হওয়া সাজে না। মর্যাদা রক্ষা করে তাঁকে চলতে হয়। নির্বাচনী প্রচারে সেই মর্যাদা রক্ষিত হয়নি।’
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে নতুন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকের দিনই নাগপুরে সংঘের সদর দপ্তরে শিক্ষানবিশদের এক অনুষ্ঠানে গত সোমবার মোহন ভাগবত এই মন্তব্য করেন। তিনি মনে করিয়ে দেন, ভারতের মতো বিশাল বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে সহমতের ভিত্তিতে চলা উচিত। সংঘ চালকের এই মন্তব্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বলে মনে করা হচ্ছে।
ভোট চলাকালীন বিজেপি সভাপতি জগৎ প্রতাপ (জেপি) নাড্ডা সংঘ সম্পর্কে এক বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিজেপি যত দিন সক্ষম ছিল না, তত দিন তাদের সংঘ সাহচর্য প্রয়োজন ছিল। এখন বিজেপি সক্ষম হয়েছে। নিজের ভালোমন্দ নিজেরাই বুঝতে শিখেছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে শিখেছে। এখন আর প্রতি পদে সংঘের প্রয়োজন নেই।’
কেন তিনি হঠাৎ ওই মন্তব্য করেছিলেন তা এক বিস্ময়। তখন থেকেই শোনা যাচ্ছিল, এবারের ভোটে সংঘ বিজেপি প্রার্থীদের জেতাতে সেভাবে সক্রিয় হয়নি। নরেন্দ্র মোদির কর্তৃত্ববাদী আচরণ তাদের পছন্দ নয়। যেভাবে সংঘের আদর্শবিরোধীদের তিনি দলে টেনেছেন, নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন, তা তাদের অনুমোদন পায়নি। এসব কারণে মোদির বিজেপির সঙ্গে সংঘের দূরত্ব বেড়েছে।
সেই রাজনৈতিক জল্পনা যে অহেতুক ছিল না, সোমবার মোহন ভাগবতের মন্তব্য তা বুঝিয়ে দিল। সেই সঙ্গে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, সরকারকে স্থিতিশীল করতে গেলে মোদিকে সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। ঐকমত্যের ওপর জোর দিতে হবে।
মণিপুরে এক বছরের বেশি সময় ধরে যে সহিংসতা চলছে, মোহন ভাগবত তাতেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সেই রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত যাননি। ভাগবত বলেন, ‘উপদ্রুত ওই রাজ্যে শান্তি ফেরানোর বিষয়ে সরকারকে এবার গুরুত্ব দিতে হবে। মণিপুরের দুটি লোকসভা আসনই ছিল বিজেপির দখলে। এবারের ভোটে দুটি আসনই ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস।’
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি বারবার নিজেকে প্রধান সেবক বলে জাহির করতেন। সেই সেবকের প্রকৃত সংজ্ঞা কী, ভাগবত তাঁর ভাষণে তা ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন, ‘যিনি বাস্তবিকই সেবক, যাঁকে সত্যি সত্যিই সেবক বলা যায়, তিনি সব সময় মর্যাদা রক্ষা করে চলেন। যিনি সেই মর্যাদা পালন করে চলতে পারেন, তিনিই কর্মবীর। কিন্তু তাঁকে কাজের মোহগ্রস্ত হলে চলবে না। কাজ করার পর যেন তাঁর অহংকার না আসে। যেন না বলেন, আমিই এই কাজ করেছি। অহংকার যাঁকে গ্রাস করে না, তিনিই প্রকৃত সেবক।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভাগবতের এই মন্তব্যের লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদি। মোদি যে অহংকারী, লোকসভায় সে কথা স্পষ্ট করে বলেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। মোদির উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘লঙ্কারাজ রাবণের পতন রামের হাতে হয়নি। রাবণের পতন ঘটিয়েছিল তাঁর অহংকার। আপনার অহংকারও পতনের কারণ হবে।’
সংঘপ্রধান এ কথাও বলেছেন, নির্বাচনকে যুদ্ধ হিসেবে দেখা ঠিক নয়। বরং তা প্রতিযোগিতার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। নির্বাচনের সময় আচরণ সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘একে অন্যের প্রতি যেভাবে অভিযোগ হেনেছে, তা অবাক করার মতো। তাদের আচরণ সমাজকে কীভাবে বিভাজিত করছে কেউ তা খেয়াল রাখেনি। তা করতে গিয়ে সংঘকে অযথা টেনে আনা হয়েছে। বিনা দোষে। প্রযুক্তির সাহায্যে অসত্য প্রচার করা হয়েছে। জ্ঞানের ব্যবহার এভাবে করতে হবে? দেশটা তা হলে চলবে কী করে?’
রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষের প্রয়োজন ও অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি বিরোধী পক্ষ বলি না। বলি প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষ বিরোধী হয় না। গণতন্ত্রে এটাই নিয়ম। দুই পক্ষে প্রতিযোগিতা হবে শালীনতা ও মর্যাদা রক্ষা করে। এবার সেটাই হয়নি। অথচ মতৈক্য জরুরি। যদিও শতভাগ মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।’
গত ১০ বছর সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছাই ছিল শেষকথা। সংঘের ইচ্ছা–অনিচ্ছা প্রাধান্য পায়নি। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো মোদির বিজেপিতে এবার সংঘের প্রভাব বাড়বে কি না, সেটাই এই মুহূর্তের জল্পনা। মোহন ভাগবতের এসব মন্তব্য বোঝাচ্ছে বিজেপির রাজনৈতিক নেতৃত্বের আচার–আচরণে সংঘ বিরক্ত। আগামী বছর আরএসএস শতবর্ষে পা দেবে। সরকারকে ঠিকপথে পরিচালনার জন্য সংঘ কতটা সক্রিয় হচ্ছে, আগামী দিনের বিভিন্ন সরকারি সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তা বোঝা যাবে।