ভারতের পুলিশ ৩০ বছর বয়সী দেশটির পাঞ্জাবের স্বঘোষিত খালিস্তানি নেতা অমৃতপাল সিংকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁকে গ্রেপ্তারে ভারতের পুলিশকে এক মাস সময় ব্যয় করতে হয়েছে। কে এই অমৃতপাল? তাঁর নেতা হয়ে ওঠা ও তাঁর গ্রেপ্তার সম্পর্কে একনজরে যা জানা দরকার—
কে এই অমৃতপাল
অমৃতপালের প্রাথমিক জীবনের বেশির ভাগ সময়ই রহস্যে মোড়া। ১৯ বছর বয়সে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে যাওয়ার আগে পাঞ্জাবের অমৃতসর জেলায় বসবাস করতেন। যেখানে তিনি তাঁর পরিবারের পরিবহন ব্যবসার জন্য কাজ করতেন। গত সেপ্টেম্বরে তিনি ভারতে ফেরেন।
দেশে ফেরার মাসেই (সেপ্টেম্বর, ২০২২) অমৃতপালকে ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দে’–এর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দে’ ভারতীয় অভিনেতা ও শিখ অধিকারকর্মী দীপ সিধুর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন। দীপ সিধু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন।
‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দে’ সংগঠনটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের চাপিয়ে দেওয়া কৃষি সংস্কার নীতির বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। তারা এ নীতির বিরুদ্ধে কৃষকদের একত্রিত করতে বিশাল প্রচারে অংশ নিয়েছিল।
দুবাই থেকে ভারতে ফেরার পর থেকে অমৃতপাল সিং শিখদের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তাঁর বক্তৃতা খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থকদের মধ্যে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
খালিস্তান আন্দোলনের শুরু ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতার সময় থেকে। তখন কিছু শিখ পাঞ্জাব রাজ্যের মধ্যে আলাদা একটি স্বাধীন শিখ জাতি গঠনের আহ্বান জানান। ১৯৭০ ও ১৯৮০–এর দশকে তাঁদের এ আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। প্রসঙ্গত, শিখরা ভারতের মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
অমৃতপালের ভাষ্য, তিনি খালিস্তান আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি প্রয়াত জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালকে গুরু হিসেবে অনুসরণ করেন। তাঁর আদর্শেই তিনি অনুপ্রেরণা পান। ভিন্দ্রানওয়াল পাঞ্জাবের মধ্যে বৃহত্তর শিখ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষের প্রবক্তা ছিলেন। তবে তিনি আলাদা শিখ রাজ্যের পক্ষে ছিলেন না।
ভারত সরকার ভিন্দ্রানওয়ালেকে সশস্ত্র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। ওই বিদ্রোহের সহিংসতায় দুই দশকে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। শিখদের পবিত্রতম স্বর্ণমন্দিরে (গোল্ডেন টেম্পল) ১৯৮৪ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী হামলা চালালে ভিন্দ্রানওয়াল ও তাঁর সমর্থকেরা নিহত হন।
অমৃতপালের চলাফেরার ধরন ভিন্দ্রানওয়ালের মতো। তিনি তাঁর মতো পোশাক পরিধান করেন ও লম্বা দাঁড়ি রাখেন। গত সেপ্টেম্বরে ভিন্দ্রানওয়ালের গ্রামে এক শোভাযাত্রায় বক্তৃতা করেন অমৃতপাল। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ভিন্দ্রানওয়াল তাঁর রক্তের প্রতিটি ফোঁটা ‘সম্প্রদায়ের স্বাধীনতার জন্য’ উত্সর্গ করে গেছেন। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখনো আমরা দাসই রয়ে গেছি...আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়ে যেতে হবে।’
খালিস্তান আন্দোলনকে বর্তমান ভারত সরকার নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং নিষিদ্ধ করে।
অমৃতপালের গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। ওই সময় তাঁর শত শত সমর্থক জেলে বন্দী থাকা তাঁদের এক সহকারীর মুক্তির দাবিতে পাঞ্জাবের একটি পুলিশ স্টেশনে হামলা চালিয়েছিলেন।
ওই হামলার সঙ্গে পুলিশ অমৃতপালকে দায়ী করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পাঞ্জাব পুলিশ গত ১৮ মার্চ রাস্তা অবরোধ করে ও হাজারো পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। তবে ওই যাত্রায় অমৃতপাল পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর পালানোর কিছু দৃশ্য তাঁর সহযোগীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারও করেছিল।
এরপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অমৃতপালকে ধরতে মাসব্যাপী অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের জন্য হাজারো আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে। পাশাপাশি পাঞ্জাবের সন্দেহভাজন কিছু এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করে।
পুলিশ বলছে, মাসব্যাপী এই অভিযানে তারা অমৃতপালের ১৫৪ জন সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে এবং ১০টি বন্দুক ও গোলাবারুদ জব্দ করেছে। অবশেষে গতকাল রোববার অমৃতপালকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁকে পাঞ্জাবের মোগা জেলার রোদে গ্রামের একটি গুরুদুয়ারা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তিনি অত্মসমর্পণ করেছেন।
অমৃতপালকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ আইনে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের কোনো অভিযোগ গঠন ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত আটকে রাখা যায়। অমৃতপালকে পাঞ্জাব থেকে ভারতের আরেক রাজ্য আসামের ডিব্রুগড় সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তাঁর আরও ৯ অনুসারী কারারুদ্ধ রয়েছেন।