বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন। এরপরই রয়েছে ভারত। এশিয়ার দুই দেশের প্রতিটিতে জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। তবে চীন হয়তো আর বেশি দিন তালিকার শীর্ষে থাকছে না। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি জনসংখ্যার দিক দিয়ে চীনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ভারত।
২০২১ সালে চীনে তুলনামূলক বেশ কম মানুষের জন্ম হয়েছিল—মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ । সে বছর দেশটিতে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, সংখ্যাটা তার চেয়ে সামান্য বেশি। সে দেশের নারীদের সন্তান জন্ম দেওয়ার হার কমে যাওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে। আর চলতি বছর থেকে চীনের জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারতেও বিগত কয়েক দশকে জন্মহার কমেছে। দেখা গেছে, ১৯৫০ সালে যেখানে একজন ভারতীয় নারী গড়ে ৫ দশমিক ৭টি সন্তান জন্ম দিতেন, বর্তমানে তাঁরা জন্ম দিচ্ছেন গড়ে দুটি সন্তান। তবে এই হার কমার গতি একটা জায়গা এসে দাঁড়িয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, ভারতের জনসংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে গেলে দেশটিতে এর প্রভাব কী হতে পারে? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজা হয়েছে বিবিসির এই প্রতিবেদনে।
শুধু চীনই নয়, এশিয়ার অনেক দেশই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভারতের চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে। বলা যায় কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান ও থাইল্যান্ডের কথা। দেশগুলো ভারতের অনেক পরে পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। তবে ভারতের আগে তারা নিজেদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে।
১৯৮৩ সালে চীনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ। এর আগে ১৯৭৩ সালে এই হার ছিল ২ শতাংশ। অর্থাৎ, মাত্র ১০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অর্ধেক কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবাধিকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এই লক্ষ্য অর্জন করেছে চীন সরকার। দেরিতে বিয়ে, এবং এক সন্তান নিতে নাগরিকদের ওপর একপ্রকার জোরজবরদস্তি চালিয়েছে দেশটি।
অন্যদিকে গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বেশির ভাগ সময় ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলক অনেক বেশি ছিল—প্রায় ২ শতাংশ। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনো বেশি বলে মনে করেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের জনতত্ত্ববিদ টিম ডাইসন। কারণ, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে মৃত্যুহার কমেছে, বেড়েছে গড় বয়স ও আয়। একই সঙ্গে শহরে বসবাস করা মানুষ আধুনিক পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ও বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সামাল দিতে ১৯৫২ সালে একটি পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প চালু করেছিল ভারত সরকার। এরপর ১৯৭৬ সালে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি কার্যকর করে তারা। সেই সময় ভারত যখন সবে জনসংখ্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে, চীন তখন পুরোদমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত ছিল।
প্রায় ২০ কোটি মানুষ ভারতের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাড়ি জমিয়েছে। এই সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে। এর বড় একটি কারণ, গ্রামের কাজের সংকট ও নিম্ন মজুরি। ফলে মানুষ কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে চলে যাচ্ছেন।
শুধু চীন নয়, এশিয়ার অনেক দেশই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভারতের চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে। বলা যায় কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান ও থাইল্যান্ডের কথা। দেশগুলো ভারতের অনেক পরে পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। তবে ভারতের আগে তারা নিজেদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এমনকি ভারতের চেয়ে দেশগুলোর মানুষের আর্থিক অবস্থারও উন্নতি হয়েছে।
১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সে সময় ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় অভিযোগ উঠেছিল। পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্পের আওতায় দেশটির কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের ওপর জোরজবরদস্তি চালিয়ে তাদের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা নষ্ট করা হয়েছিল।
এ নিয়ে সে সময় ভারতবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। টিম ডাইসনের ভাষ্যমতে, জরুরি অবস্থা জারি না করা হলে এবং রাজনীতিকেরা আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলে ভারতে সন্তান জন্মদানের হার আরও দ্রুত কমত।
প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই জাতিসংঘের সদস্য ভারত। তবে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে জোর দাবি জানিয়ে আসছে দেশটি। বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশ চীনসহ পাঁচটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ হলে ভারতের ওই দাবি আরও পোক্ত হবে।
এই বিশেষজ্ঞদের একজন জন উইলমোথ। তিনি জাতিসংঘের ইকোনমিক ও সোশ্যাল অ্যাফেয়ারর্স ডিপার্টমেন্টের জনসংখ্যাবিষয়ক বিভাগের পরিচালক। জন উইলমোথ বলেন, ‘আমি মনে করি, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ হওয়ার মাধ্যমে ভারতের সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি থাকতেই পারে।’
আরেকটি ভালো খবর হলো, বিশ্বে ২৫ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচজনের একজন বাস করেন ভারতে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশের বয়সই ২৫ বছরের কম। আর তিন ভাগের দুই ভাগ ভারতীয়র জন্ম গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে। ওই সময় অর্থনীতির দিক দিয়ে ভারতের বেশ অগ্রগতি হয়েছিল।
এই তরুণেরা ভারতের জন্য আশীর্বাদ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ শ্রুতি রাজাগোপালান। তিনি বলেন, এই তরুণ প্রজন্ম ভারতে সবচেয়ে বড় ভোক্তা শ্রেণি তৈরি করবে। এ ছাড়া তাঁরা দেশটিতে সবচেয়ে বড় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীতেও পরিণত হবে।
ভারতের এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা দেশটির জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে হবে। কারণ, বর্তমানে জন্মহার তুলনামূলক কমে যাওয়ায় তাঁদের সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনে কম সময় দিতে হচ্ছে। ফলে তাঁদের অন্যান্য কাজ করার সুযোগ বাড়ছে।
তবে ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) দেওয়া তথ্য বলছে, গত অক্টোবরে ভারতে মাত্র ১০ শতাংশ কর্মক্ষম নারী বিভিন্ন কাজে ছিলেন। একই সময়ে চীনে বিভিন্ন ধরনের পেশায় জড়িত ছিলেন দেশটির ৬৯ শতাংশ কর্মক্ষম নারী।
আরেকটি সমস্যা হলো, প্রায় ২০ কোটি মানুষ ভারতের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাড়ি জমিয়েছেন। এই সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে। এর বড় একটি কারণ, গ্রামে কাজের সংকট ও নিম্ন মজুরি। ফলে মানুষ কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে চলে যাচ্ছেন।
কেরালাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের বিশেষজ্ঞ এস ইরুদায়া রাজনের ভাষ্যমতে, জনসংখ্যার স্থানান্তরের ফলে শহরে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এখন শহরে এই মানুষগুলো মানসম্মত জীবনযাপন করতে পারবে কি না, সেটা বড় একটি প্রশ্ন। সেটা না হলে শহরাঞ্চলে বস্তির সংখ্যা বাড়বে, দেখা দেবে রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব।
১৯৪৭ সালে ভারতে গড় বয়স ছিল ২১ বছর। সে সময় প্রায় ৫ শতাংশ মানুষের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। বর্তমানে মানুষের গড় বয়স ২৮ বছরের বেশি। আর ৬০ বছরের বেশি মানুষের সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি। এখন বিশাল এক জনগোষ্ঠী তরুণ, তাঁরা এক সময় ভারতের সবচেয়ে বড় বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবেন।
‘হোল নাম্বারস অ্যান্ড হাফ ট্রুথস: হোয়াট ডেটা ক্যান অ্যান্ড ক্যান নট টেল আস অ্যাবাউট মডার্ন ইন্ডিয়া’ বইয়ের লেখক রুক্মিণী এস বলেন, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যত কমবে, ততই বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী বাড়বে। ফলে তাঁরা সরকারের বোঝায় পরিণত হবেন। তাই সরকারের পরিবার কাঠামোর বিষয়ে আরও বেশি নজর দিতে হবে।