সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ যে প্রতিবেদন পেশ করেছে, তাতে অবশ্য পরিষ্কার, যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির যত গুরুতর অভিয়োগই থাকুক না, বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর সব চাপা পড়ে যাচ্ছে।
দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), সিবিআই ও আয়কর বিভাগের অভিযান কতখানি ‘রাজনৈতিক’, সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে অন্যান্য দলের ২৫ শীর্ষস্থানীয় নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ‘গুরুতর’ অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছিল। মামলাও। কিন্তু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর কারও কারও মামলা প্রত্যাহৃত হয়েছে। অধিকাংশ তদন্তের কোনো অগ্রগতিই নেই।
বেশ কিছুদিন ধরেই বিজেপিকে বিরোধীরা ‘ওয়াশিং মেশিন’–এর সঙ্গে তুলনা করছেন। তাঁদের অভিযোগ, ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগকে দিয়ে তল্লাশি চালিয়ে বিরোধী নেতাদের বিজেপি ভয় দেখিয়ে দলে টানছে। বিরোধীদের সরকার ভাঙছে। নিজেদের সরকার গড়ছে।
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ইডি, সিবিআই যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত-তল্লাশি চালিয়েছিল, তাঁদের ৯৫ শতাংশই ছিলেন বিরোধী দলের।
আম আদমি পার্টির (এএপি) নেত্রী ও দিল্লির মন্ত্রী আতিশী গতকাল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, তাঁকে বিজেপিতে যোগ দিতে টোপ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, না হলে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হবে। বলা হয়েছে, তাঁর কাছে পছন্দ দুটি। বিজেপিতে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক জীবন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, নয়তো কারাগারে যেতে হবে।
বিরোধীদের এই জাতীয় অভিযোগ বিজেপি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে চলেছে। বিজেপি নেতাদের কথায়, তদন্তকারী সংস্থারা স্বাধীন। আইন অনুযায়ী তারা কাজ করছে। সরকার প্রভাব খাটায় না। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের রামলীলা ময়দানের জমায়েতের দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেন, ‘বিরোধীরা লড়ছেন দুর্নীতিগ্রস্তদের রক্ষার জন্য, আমি লড়ছি দুর্নীতির বিনাশ করতে।’
আজ বুধবার সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ যে প্রতিবেদন পেশ করেছে, তাতে অবশ্য পরিষ্কার, যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির যত গুরুতর অভিযোগই থাকুক না, বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর সব চাপা পড়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো মামলা ‘ক্লোজ’ করে দেওয়া হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে প্রকাশিত শীর্ষ নেতাদের তালিকায় কংগ্রেসের ১০ জন, এনসিপি ও শিবসেনার ৪ জন করে ৮ জন, তৃণমূল কংগ্রেসের ৩ জন, তেলুগু দেশম পার্টির ২ জন এবং সমাজবাদী পার্টি ও ওয়াইএসআর কংগ্রেসের ১ জন নেতা রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ২৩ জনের বিরুদ্ধে হয় তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, নয়তো কোনো অগ্রগতিই নেই। দুইজনের বিরুদ্ধে অবশ্য তদন্ত এখনো চলছে।
এই ২৫ নেতার মধ্যে ৬ জন নির্বাচনের মুখে এই বছরেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইডি, সিবিআই যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত–তল্লাশি চালিয়েছিল, তাঁদের ৯৫ শতাংশই ছিলেন বিরোধী দলের।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মাও রয়েছেন এই তালিকায়। সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সিবিআই তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছিল ২০১৪ সালে। ২০১৫ সালে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়ে আপাতত মুক্ত।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজনৈতিক স্বার্থে ইডি–সিবিআইকে কাজে লাগানোর প্রবণতা বিজেপি আমলে বহুগুণ বেড়ে গেছে। ২০০৯ সালের উদাহরণ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সে সময় সিবিআই মুলায়ম সিং যাদব ও মায়াবতীর বিরুদ্ধে তদন্তে ঢিলেমি দিয়েছিল। কারণ, ক্ষমতাসীন ইউপিএ সরকার তাঁদের কাছে টানার চেষ্টায় ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজেপি জমানায় এই অতিসক্রিয়তা মারাত্মকভাবে বেড়ে যায় ২০২২–২৩ সালে। তখন বেশির ভাগ নজর ছিল মহারাষ্ট্রে। ওই সময়ে বিজেপি প্রথমে ভাঙন ধরায় শিবসেনায়, পরে এনসিপিতে। তারপর রাজ্যে সরকার গড়ে। এনসিপির দুই শীর্ষ নেতা অজিত পাওয়ার ও প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় মামলা ‘ক্লোজ’ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ দুজনের ‘দুর্নীতির’ বিরুদ্ধে কামান দাগিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি স্বয়ং।
অজিত পাওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ৭০ হাজার কোটি রুপির দুর্নীতি, প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধে ৩০ হাজার কোটির। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, শীর্ষ ২৫ নেতার মধ্যে ১২ জনই মহারাষ্ট্রের।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এই ২৫ শীর্ষ নেতার নাম, তাঁদের দল, দুর্নীতির অভিযোগ এবং তদন্ত বর্তমানে কোন অবস্থায় রয়েছে—সব বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছে।
বিজেপিতে যোগ দেওয়া মহারাষ্ট্রের রাজনীতিকদের মধ্যে রয়েছেন রাজ্যের জোট সরকারের উপ মুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ার। ২০২৩ সালে তিনি এনডিএতে যোগ দেন। রয়েছেন প্রফুল্ল প্যাটেল। ইউপিএ আমলে তিনি ছিলেন বেসামরিক পরিবহনমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে ৩০ হাজার কোটি রুপির দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল বিজেপি। অজিতের মতো তিনিও এনসিপি ছেড়ে এনডিএতে গেছেন। যেমন গেছেন চিনি কেলেঙ্কারির পান্ডা বলে পরিচিত হাসান মুশরিফ। অজিতের সঙ্গে তিনিও এনডিএতে যোগ দিয়েছেন। তদন্তও বন্ধ।
শিবসেনা থেকে বিজেপিতে গেছেন প্রতাপ সরনায়েক, যামিনী ও যশবন্ত যাদভ, ভাবনা গাওলি। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস ছেড়ে সদ্য বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অশোক চহ্বান, মুম্বাই কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি কৃপাশঙ্কর সিং, ছগন ভুজবাল, বাবা সিদ্দিকি ও অর্চনা পাতিল। অর্চনা হলেন কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা লোকসভার সাবেক অধ্যক্ষ শিবরাজ পাতিলের পুত্রবধূ। তাঁর ও তাঁর স্বামীর আয়কর মামলা চলছিল। মাত্র কদিন আগে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরই ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত নয়।
গোয়ার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের দিগম্বর কামাত বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন ২০২২ সালে। তার পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত ধামাচাপা পড়েছে। হরিয়ানার শিল্পপতি নবীন জিন্দাল ছিলেন কংগ্রেসের বড় নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে কয়লা কেলেঙ্কারি মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। কয়েক দিন আগে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে তিনি লোকসভা ভোটে প্রার্থী হয়েছেন। এঁদের কারও বিরুদ্ধেই এখন আর তদন্ত হচ্ছে না।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মাও রয়েছেন এই তালিকায়। সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সিবিআই তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছিল ২০১৪ সালে। একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় তাঁকে। ২০১৫ সালে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়ে আপাতত মুক্ত। মামলা চলছে না চলার মতোই।
এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে নাম রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগী শুভেন্দু অধিকারী, শোভন চট্টোপাধ্যায় ও তাপস রায়ের। শুভেন্দুর বিরুদ্ধে তদন্ত চালাতে সিবিআই ২০১৯ সালে লোকসভার স্পিকারের অনুমতি চেয়েছিল। আজও তা মেলেনি। তিনি এখন রাজ্য বিজেপির সবচেয়ে বড় নেতা। শোভন রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। তাপস সদ্য বিজেপিতে গেছেন। কলকাতা পৌরসভায় নিযুক্তি নিয়ে ইডি কিছুদিন আগে তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালায়। তারপরই তিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে লোকসভা ভোটে প্রার্থী হয়েছেন।
এই প্রতিবেদন ছাপার আগে পত্রিকার পক্ষ থেকে ইডি, সিবিআই ও আয়কর বিভাগের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। কেউ উত্তর দেয়নি বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিবিআইয়ের একটি সূত্র বলেছে, তদন্ত চালানো হয় প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে। ঠিক প্রমাণ মিললেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিলম্ব হতে পারে, তবে মামলা চলছে।
ইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে তারা অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। যখন দরকার পড়ে, তখন তারা ব্যবস্থা নেয়।