শিখ আন্দোলনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুন
শিখ আন্দোলনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুন

যুক্তরাষ্ট্রে শিখনেতা হত্যাচেষ্টায় অভিযুক্ত বিকাশের নামে ভারতে কেন হঠাৎ মামলা-অভিযোগপত্র

বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবি জানায়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে সেই দাবি জানানো হবে কি না, হলে কবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আভাস আসছে, সে দেশের শিখনেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিকাশ যাদবকে প্রত্যর্পণ করতে তারা সম্ভবত ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাবে। কূটনীতির আঙিনায় তাই হঠাৎই প্রত্যর্পণের প্রশ্ন প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে।

দুটি ঘটনা আদৌ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কিন্তু দুটি ঘটনার সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে প্রত্যর্পণের প্রশ্ন। শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রিতা। স্বল্প সময়ের নোটিশে তিনি দেশ ছেড়ে সাময়িকভাবে চলে এলেও ৫ আগস্ট থেকে এখনো তিনি ভারতেই আছেন অতিথি হয়ে। সরকারিভাবে তা স্বীকারও করা হচ্ছে।

মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে সাজার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্তও অপরাধীকে বন্দী রাখা যায়। অতএব বিকাশ যাদবকে এখনই হস্তান্তরের প্রশ্ন উঠছে না। ভারত চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে না দিয়ে তাঁকে অনির্দিষ্টকাল দেশে আটকে রাখতে পারে।

তবে বিকাশ যাদব নিয়ে ভারত সরকার অনেকটাই নীরব। তিনি দেশে আছেন কি না, থাকলেও কোথায় ও কীভাবে, সে বিষয়ে সরকার এখনো স্পষ্ট কিছু জানায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শুধু বলেছে, তিনি এখন আর সরকারি কর্মী নন।

এর অর্থ কিন্তু প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া যে বিকাশ একটা সময় ভারত সরকারের কর্মী ছিলেন। লক্ষণীয়, যুক্তরাষ্ট্রে পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং কানাডায় হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যা—দুটি অভিযোগেরই চরিত্র এক। পান্নুন ও নিজ্জর দুজনেই ভারতের চোখে শিখ সন্ত্রাসবাদী বলে পরিচিত। নিষিদ্ধ শিখ সংগঠনের নেতা। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ভারত অস্বীকার করেনি। বরং ব্যবস্থা নিয়েছে। অথচ কানাডার অভিযোগ সরাসরি মিথ্যা ও রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, সে দেশের মাটিতে মার্কিন নাগরিক পান্নুনকে হত্যার চেষ্টার সঙ্গে বিকাশ সরাসরি যুক্ত। ভারতীয় দূতাবাসে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইং’য়ের (র) কর্মী ছিলেন তিনি। বিকাশ ওই কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন নিখিল গুপ্ত নামের একজনকে, যিনি নিয়োগ করেছিলেন এক ‘ভাড়াটে খুনিকে’। সেই সম্ভাব্য খুনি আবার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রেরই এক চর—‘আন্ডার কভার’ এজেন্ট। নিখিলকে গ্রেপ্তার করা হয় চেক প্রজাতন্ত্রে। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। তারা এবার বিকাশকে পেতে প্রত্যর্পণের দাবি জানাবে বলে শোনা যাচ্ছে।

সে ক্ষেত্রে কী করবে ভারত? বেশি আলোচনা আপাতত এ নিয়েই। এই আলোচনায় হাসিনার বিষয়টি অনেক পিছিয়ে। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে ‘রাজনীতির’ বিষয়টিও জড়িত। বিকাশের বিষয়টি একেবারেই আলাদা, সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত। তা ছাড়া বিকাশের প্রত্যর্পণের বিষয়টি বাস্তবায়িত হলে তা আসবে বন্ধু ‘সুপার পাওয়ার’ যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সাবেক কূটনীতিকের কথায়, তিনটি বিষয়কে এক দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবি জানানো হলে তা এড়ানোর অনেক উপায় দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতেই আছে। কানাডার অভিযোগ ভারত উড়িয়ে দিতে পারছে, সে দেশে বসবাসকারী শিখ সম্প্রদায়ের একাংশের তীব্র ভারতবিরোধিতা এবং জাস্টিন ট্রুডো সরকার তাদের সমর্থনের ওপর টিকে আছে বলে। এ ছাড়া প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও সে দেশে আশ্রয় পাওয়া বহু ‘অপরাধীকে’ ভারতও এখনো ফেরত পায়নি।

ওই কূটনীতিক বলেন, একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী দেশ দ্বিতীয়টি নেই। কাজেই যত সহজে বাংলাদেশ ও কানাডার অভিযোগ এবং দাবি অস্বীকার ও উপেক্ষা করা যায়, তত সহজে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি উপেক্ষা করা যায় না। সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ভারত নমনীয়, কানাডার ক্ষেত্রে কঠোর।

অবশ্য দাবি মেটাতে টালবাহানার বহু উপায় আছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সই করা প্রত্যর্পণ চুক্তিতেও। সম্প্রতি ভারতীয় দৈনিক পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির পুলিশ এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে বিকাশ যাদবকে গ্রেপ্তার করেছিল। ২০২৪ সালের মার্চে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়। এপ্রিলে তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

সময়গুলো লক্ষ করার মতো। পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল গত বছর, ২০২৩ সালের মে মাসে। যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারী দলের মতে, ওই সময়েই নিখিলকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিকাশ। সেই বছরের জুনে নিখিলকে গ্রেপ্তার করা হয় চেক প্রজাতন্ত্রে। ২০২৪ সালের জুনে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয়। বিকাশের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীকে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টার মামলা দেওয়া হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে।

এ মামলার কারণেই বিকাশ যাদবকে দীর্ঘকাল ভারতে রেখে দেওয়া যেতে পারে। আইনি বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, দেশে কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাউকে প্রত্যর্পণ করা যায় না। এ ছাড়া মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে সাজার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্তও অপরাধীকে বন্দী রাখা যায়। অতএব বিকাশ যাদবকে এখনই হস্তান্তরের প্রশ্ন উঠছে না। ভারত চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে না দিয়ে তাঁকে অনির্দিষ্টকাল দেশে আটকে রাখতে পারে।

বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম (আনার) পশ্চিমবঙ্গে খুন হন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। অভিযোগ, অপরাধ করার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তা ছাড়া অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ভারতে। কাজেই প্রত্যর্পণের অধিকার কারও থাকলে তা ভারতের।

যুক্তরাষ্ট্রও এই এক যুক্তিতে এখনো ভারতের হাতে তুলে দেয়নি তাহাউর রানাকে। ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর (২৬/১১) মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ডেভিড কোলম্যান হেডলি ও তাঁর দোসর তাহাউর রানা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের জেলে বন্দী। ২০১৩ সালে হেডলির ৩৫ বছরের সাজা হয়েছে। লস্কর-এ-তাইয়্যেবার সঙ্গে যুক্ত রানার প্রত্যর্পণ মামলার পূর্ণাঙ্গ নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। এর মধ্যে ১৭ বছর পার হয়ে গেছে।

বিকাশ যাদবের প্রত্যর্পণের ভাগ্যও তেমনই হতে পারে। দেশে রুজু হওয়া মামলার নিষ্পত্তি ও অপরাধী প্রতিপন্ন হলে সাজার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভারত কিছু না-ও করতে পারে।

কূটনীতিকদের মতে, আরও অনেক কিছু এখনো অজানা। যেমন পান্নুন মামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত কতটা উদ্যোগী হবে, জানা নেই। দ্বিতীয়ত, ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে মিত্রদেশ ভারতের ওপর তারা এই বিষয়ে কতটা চাপ দেবে, তা-ও অজানা। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রাজনৈতিক পালা বদল ঘটলে পরবর্তী সরকার এ বিষয় কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে, সেটাও অনুমানসাপেক্ষ ও অনিশ্চিত।