বাংলাদেশে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যশিক্ষা বিষয়ে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ রয়েছে। সাম্প্রতিক আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেল।
সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসা ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, এখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছেন। তবে পশ্চিমবঙ্গ, কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি।
কিশোরগঞ্জের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের সুদীপ্ত মাইতি। তিনি বছর চারেক আগে বাংলাদেশে পড়তে যান। সে সময় যত ভারতীয় শিক্ষার্থী বাংলাদেশে ছিলেন, তার চেয়ে এখন সংখ্যাটা বেড়েছে বলে জানান তিনি। তাঁর ধারণা, সংখ্যাটা বেশ কয়েক হাজার হতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি ভারতীয় সংসদে জানান, ৯ হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়ছেন। বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতে তাঁদের বড় অংশই গত জুলাইয়ে ভারতে ফিরে এসেছেন।
সুদীপ্তর মতে, এই ভারতীয় শিক্ষার্থীর বাংলাদেশে পড়তে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ যাওয়া-আসার সুবিধা।
সুদীপ্ত বলেন, ‘এই গন্ডগোলের সময়েও আমরা আখাউড়া থেকে আগরতলা হয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কলকাতায় চলে এলাম। সেখান থেকে আমার বাড়ি মেদিনীপুরে পৌঁছাতে আরও কিছুটা সময় লাগল। এটা অন্য দেশ হলে সম্ভব হতো না।’
অন্য দেশ বলতে রাশিয়া, ইউক্রেন, চীনসহ মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কথা বুঝিয়েছেন সুদীপ্ত। এসব দেশেও পড়তে যান ভারতের শিক্ষার্থীরা। এসব দেশেও পড়ার খরচ অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু এসব দেশের ক্ষেত্রে এত দ্রুত যাওয়া-আসা করা যায় না।
সুদীপ্তর কথায়, অন্যত্র যাওয়া-আসার অসুবিধার পাশাপাশি ভাষার সমস্যাও রয়েছে। আর খাওয়াদাওয়ার সমস্যা তো আছেই। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগব্যবস্থা এখন এতই ভালো যে প্রায় সব জায়গা থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেশে ফিরে আসা যায়। সম্ভবত এ কারণে ভারত থেকে এত শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে পড়াশোনা প্রসঙ্গে কাশ্মীরের এক ছাত্রী, যিনি নিজেকে শুধু ‘কাজি’ নামে পরিচয় দিতে ইচ্ছুক, তিনি বললেন, ‘পড়ার সুযোগ ও খরচ—দুটিই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
এমবিবিএসের পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী কাজি বললেন, ‘আমি ২০১৯ সালে ঢাকার আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজে পড়ার জন্য বাংলাদেশে যাই। তখন কাশ্মীরে মাত্র দুটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ছিল। আর কোনো প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এখানে ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ সে সময় অনেকগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ছিল। যে কারণে আমি ও আমার অনেক বন্ধু বাংলাদেশে পড়তে যাই।’
ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তিতে সহায়তা করেন কলকাতার শিক্ষা পরামর্শদাতা কাজী মহম্মদ হাবিব। তাঁর সংস্থা চেকমেট ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। তাঁদের পড়তে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করাসহ কলেজ পর্যন্ত যেতে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করে।
মহম্মদ হাবিব বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। দেশটিতে দ্রুত বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বেড়েছে, বাড়ছে। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে পড়তে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি। তবে দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আগামী কয়েক বছর হয়তো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ তৈরি হওয়ার প্রবণতা কমবে। তবে এই দুই সংকট কাটলে আবার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বাড়বে। তখন দেশটিতে ভারতীয় শিক্ষার্থী যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশে পড়তে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে কম খরচের বিষয়টি উল্লেখ করেন কাশ্মীরের ছাত্রী কাজি ও তাঁর আরেক বন্ধু।
কাজি বলেন, ভারতে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তে এক কোটি রুপির মতো খরচ পড়ে। আর আনুষঙ্গিক সব খরচ ধরলে ব্যয় কোটি রুপি ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে সব মিলিয়ে মোটামুটিভাবে ৪০ থেকে ৫০ লাখ রুপি সমমানের খরচে পড়াশোনা শেষ করা যায়।
সুদীপ্ত বলেন, ঢাকার মতো প্রধান শহরের বাইরে ছোট উপশহরে এই খরচ দাঁড়ায় ৩০-৩৫ লাখ রুপির সমপরিমাণ।
কিশোরগঞ্জের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজে সুদীপ্তর চেয়ে এক বছরের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিত আনোয়ার। তাঁর ভাষ্য, মূলত খরচ কম বলেই ভারতীয় শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে পড়তে যান। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেখানে পড়াশোনার মান খারাপ।
একজন ভারতীয় শিক্ষার্থী যদি বিদেশে মেডিকেল অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন, তাহলে দেশে ফিরে তাঁকে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার জন্য ফরেন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েশন এক্সামিনেশন (এফএমজিই) পাস করতে হয়। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে পড়ে এলে এ ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেওয়া হয়।
যেসব শিক্ষার্থী মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ বা রাশিয়া থেকে পড়ে আসেন, তাঁদের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে পড়ে আসা শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি সংখ্যায় এফএমজিই পাস করেন বলে জানান বাসিত। তাঁর মতে, এর একটি সম্ভাব্য কারণ হলো উভয় দেশের পাঠ্যক্রম মূলত একই। ভারতে তাঁরা যে বই পড়েন, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই বই পড়তে হয়। শিক্ষকদের অনেকে ভারতে পড়েছেন। তাঁরা ভারতীয় শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন। তাঁরা জানেন, ভারতীয় শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরে এফএমজিই পরীক্ষায় বসতে হবে। ভারতে প্র্যাকটিস করার জন্য। ভারতের চাহিদা সম্পর্কে এই সচেতনতার কারণে এখানকার ছেলেমেয়েরা অনেকেই বাংলাদেশে পড়তে যাওয়া পছন্দ করেন।
এফএমজিই পরীক্ষায় পাস করাটা অবশ্য খুব একটা সমস্যার নয় বলে মনে করেন বাসিত। মোট ১৯টি বিষয় নিয়ে ৩০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষায় ১৫০ নম্বর পেলেই চিকিৎসক হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাসিত জানান, এখানে কোনো নেগেটিভ নম্বর দেওয়া হয় না। এটা অন্য সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মতো নয়, যেখানে যাঁরা বেশি নম্বর পাবেন, তাঁরাই পরবর্তী পর্যায়ে যেতে পারবেন। এখানে ১৫০ নম্বর পেতে হবে। তাহলেই একজন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতে পারবেন। এই ব্যবস্থা রাখার প্রধান কারণ দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা কম। তাই এটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নয়। আর একেকজন অনেকবার এফএমজিই দিতে পারেন। ফলে শেষ পর্যন্ত পাস করাটা খুব সমস্যা নয়।
তবে এ ক্ষেত্রে অন্য একটি সমস্যা রয়েছে বলে জানালেন বাসিত। তাঁর ভাষ্য, ‘আমাদের যে অংশটা থিওরি (তত্ত্ব), সেই অংশটা প্রায় পুরোপুরি ভারতের পাঠ্যক্রমের মতো। তবে প্র্যাকটিক্যাল (ব্যবহারিক) অংশটায় কিছু সমস্যা আছে। এখানে হয়তো কিছুটা কম সময় দেওয়া হয়, যার ফলে বিষয়টা পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। তবে ভারতে ফিরে এফএমজিই দিয়ে যখন একজন শিক্ষার্থী কোনো মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করতে শুরু করেন, তখন এই ঘাটতিটা পুষিয়ে নেওয়া যায়।’
বাসিতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেন তাঁর অন্য বন্ধুরাও।
মহম্মদ হাবিব বলেন, বাংলাদেশে ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে প্রায় ৩ হাজার ১০০ আসন আছে। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। এই বিদেশি শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই ভারতের।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মোট ১ হাজার ৬৭ জন ভারতীয় শিক্ষার্থী সে দেশে মেডিকেলে পড়তে গেছেন। নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান থেকে গেছেন যথাক্রমে ২৬৪ জন, ১২ জন ও ২ জন। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফিলিস্তিন থেকে গেছেন একজন করে শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের সরকারি মেডিকেল কলেজে সার্কভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য ২২০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে ২২ জনকে পাঠাতে পারে ভারত।
মহম্মদ হাবিব মনে করেন, বাংলাদেশে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের বিস্তারের ফলে সার্কভুক্ত দেশের যেমন লাভ হয়েছে, তেমনি লাভ হয়েছে বাংলাদেশেরও। সে দেশে এমবিবিএস পড়ার খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৫০ লাখ রুপির সমপরিমাণ। সুতরাং ভারতীয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে একটা ভালো অঙ্কের অর্থ আয় করছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মেডিকেলে ভারতীয় শিক্ষার্থী যখন বাড়ছে, তখন আবার বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য আসছেন। কেন এমনটা হচ্ছে, এটা একটা বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরে মহম্মদ হাবিব বলেন, এখানে একটা দিক হলো চিকিৎসা অধ্যয়ন, অপরটি হলো চিকিৎসাসেবা। বাংলাদেশে বিশেষত চিকিৎসাশিক্ষার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসাসেবায় তারা এখনো পিছিয়ে আছে। এ কারণে বাংলাদেশি রোগীরা ভারতে আসেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাশাপাশি অন্য বিষয়েও ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে পড়তে দেখা যাচ্ছে। যেমন পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের কথা বলা যায়। এই প্রতিষ্ঠানটি ফটোগ্রাফি, ভিডিও, টেলিভিশন, ফিল্ম আর্টের চর্চা করে। এখানে ছয় মাসের কোর্স করে দেশে ফিরেছেন পশ্চিমবঙ্গের সুপর্ণা নাথ। তিনি বলেন, পাঠশালা একটি ভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান। তাই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ছে।
ভারতীয় শিক্ষার্থীসহ বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ‘এডুকেশন হাব’ হিসেবে গড়ে উঠছে বাংলাদেশ। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছেন।
ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, বাংলাদেশে পড়ালেখা করার ক্ষেত্রে তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এসেছেন। তাঁরা আন্তরিক উষ্ণতা পেয়ে এসেছেন। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক আন্দোলনের জেরে তাঁদের যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, তা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। রাতের অন্ধকারে দেশে ফেরার জন্য তাঁদের অ্যাম্বুলেন্স করে বিমানবন্দরে ছুটতে হয়েছিল। পথে নানান মর্মান্তিক দৃশ্য চোখে পড়েছে। তবে তাঁরা এখন আশা করছেন, শিগগিরই বাংলাদেশের পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে। তাঁরা বাংলাদেশে গিয়ে আগের মতো স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা শেষ করতে পারবেন।