সোমনাথ ভারতীর বয়স মাত্র পঞ্চাশ, কিন্তু মাথা ইতিমধ্যেই প্রায় ফাঁকা। চকচকে টাকের ওপর পাতলা কয়েক গাছা চুল অবশিষ্ট। ৪ জুনের পর সেগুলোও থাকবে কি না সন্দেহ। কেননা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলে মাথা মুড়িয়ে ন্যাড়া হয়ে যাবেন।
দিল্লির আম আদমি পার্টির (এএপি) এই নেতা দিল্লি বিধানসভার সদস্য। এবার তিনি দক্ষিণ দিল্লি কেন্দ্র থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। লড়েছেন বিজেপি মোদি সরকারের প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের মেয়ে বাঁশুরি স্বরাজের বিপক্ষে।
এক্সিট পোল বা বুথফেরত সমীক্ষার ফল প্রকাশের পর সোমনাথ ন্যাড়া হওয়ার ওই প্রতিজ্ঞার কথা ‘এক্স’ মারফত জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মোদি তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলে মাথা কামিয়ে দেব। ৪ জুন বুথফেরত সমীক্ষা ভুল প্রমাণিত হবেই। দিল্লির সাতটি আসনই “ইন্ডিয়া” পাবে। আমার কথা মিলিয়ে নেবেন, মোদি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হবেন না।’
এই ধারণা ইন্ডিয়া জোটের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে বলেই জোট নেতারা জোটবদ্ধ হয়ে বুথফেরত জরিপের বিরোধিতায় নেমেছেন শুরু থেকেই। মল্লিকার্জুন খাড়গে, রাহুল গান্ধী, সীতারাম ইয়োচুরি, অখিলেশ যাদব, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা প্রত্যেকেই ওই সমীক্ষার ফল ফুঁৎকারে উড়িয়ে নিজেদের বিপুল জয়ের আগাম ঘোষণা দিয়েছেন।
শুধু বিরোধী নেতারাই নন, স্বাধীন সাংবাদিক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে নিজস্ব অভিমত জানিয়ে আসছেন এমন বিশেষজ্ঞরা গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে দাবি করছেন, বুথফেরত জরিপ সরকারের দিকে তাকিয়ে সরকারি উদ্যোগেই তৈরি। তার সঙ্গে জমিনি বাস্তবতার কোনো মিল নেই। সোমনাথ ভারতীর ন্যাড়া হয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা সেই বিরোধিতারই অন্য এক প্রকাশ।
এই মহল বিজেপির জয় নির্ঘোষের মধ্য দিয়ে ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। গত শনিবারই তাঁরা জানিয়েছিলেন, এই সাজানো সমীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে শেয়ারবাজার আরও চাঙা করে তুলতে। আজ সোমবার বাজার খুলতে না খুলতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। বিজেপি ৩০০ আসনের বেশি ও এনডিএ প্রায় ৪০০–এর কাছাকাছি চলে যাবে, সেই আশায় শেয়ারবাজার তেজি হয়ে ওঠে। বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক সেনসেক্স চড়চড়িয়ে উঠে যায় দুই হাজার পয়েন্ট। ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক নিফটিও দিল রেকর্ড লাফ।
আদানি গোষ্ঠীর সব শেয়ারের দাম ১৬ শতাংশ বেড়েছে। স্টকের দাম বাড়ায় ওই গোষ্ঠীর মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৬০ লাখ কোটি রুপি! বিরোধী দল ও স্বাধীন সাংবাদিক মহলের মতে, ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে বুথফেরত সমীক্ষার ফল প্রকাশ করার ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য এটাই। সম্পদ বৃদ্ধি।
ভোট পর্ব শুরুর আগে থেকেই নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বার সরকার গঠন নিয়ে তেমন একটা সংশয় ছিল না। কেননা, তখনো বিরোধীরা ছাড়া ছাড়া ছিল। মোদির বিপরীতে কোনো মুখ ছিল না। কোনো কর্মসূচি ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিরোধীরা কিছুটা সংঘবদ্ধ হয় এবং বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধিসহ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যাকেই তারা প্রচারের মূল অভিমুখ করে তোলে। ভোট শুরু হতেই দেখা যায়, দেশের কোথাও আগের দুবারের মতো মোদির পক্ষে হাওয়া নেই।
সেই হাওয়াহীনতা বিরোধীদের উৎসাহী করে তোলে। ক্রমেই এমন একটা ধারণার জন্ম হয় যে অন্যবারের মতো বিজেপি এবার একা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সরকার গড়তে গেলে অন্য শরিকদের ওপর নির্ভর করতে হবে। সরকার গড়ার ম্যাজিক ফিগারের কিছুটা দূরে তারা থমকে যেতে পারে।
বিরোধীদের সেই বিশ্বাস এখনো অটুট। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাই তিহার জেলে ফেরত যাওয়ার আগে বলে যান, বুথফেরত জরিপ পুরোপুরি মিথ্যা। মনগড়া। এতটাই ঘরে বসে বানানো যে একটা সংস্থা রাজস্থানে বিজেপিকে ৩৩টি আসন দিয়েছে। অথচ মরুরাজ্যের মোট আসন সংখ্যা ২৫। কেজরিওয়ালের মতে, বুথফেরত জরিপের ফল ওপরওয়ালার নির্দেশেই তৈরি।
বিরোধী নেতারা বলছেন, এটা করা হয়েছে একটাই কারণে। বিজেপি জিতেই গেছে সেই হাওয়া তুলে দিয়ে বিরোধীদের মনোবল ভেঙে দেওয়া, যাতে গণনার দিন শাসকদল ফাঁকায় গোল করে যেতে পারে। তা যাতে না হয়, সে জন্য সব বিরোধী নেতা ৪ জুন প্রত্যেক এজেন্টকে সতর্ক ও সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, শেষ ভোট গোনা পর্যন্ত কেউ যেন গণনাকেন্দ্র না ছাড়েন।
সম্ভাব্য ফল নিয়ে দুই বিশিষ্ট ভোট বিশেষজ্ঞের অভিমত এত দিন আলোচনার শীর্ষে ছিল। প্রশান্ত কিশোর মনে করেন, বিজেপিই ক্ষমতায় আসবে গতবারের তুলনায় কিছু কম বা বেশি আসন নিয়ে। তবে তা কিছুতেই ৪০০ আসনের কাছাকাছি যাবে না। অন্যদিকে যোগেন্দ্র যাদবের ধারণা, বিজেপি ২৭০ আসনের কাছাকাছি পৌঁছে সরকার গড়বে। তবে তারা ২৪০–২৫০ আসনেও নেমে আসতে পারে।
বুথফেরত জরিপের ফল প্রকাশের পর প্রশান্ত কিশোর নিজের বিরক্তি চেপে রাখতে পারেননি। ‘এক্স’ মারফত পরামর্শ দিয়েছেন, এর পর থেকে আর ভুয়া সাংবাদিক, নিজের ঢাক পেটানো রাজনীতিক ও স্বঘোষিত ভোট পণ্ডিতদের বিশ্লেষণ শুনে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। যোগেন্দ্র যাদব নিজের অভিমতই আঁকড়ে আছেন।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কেরালার রাজনীতি চিরকালই কংগ্রেস ও বামপন্থীদের মধ্যে বিভাজিত। বিজেপি সেখানে আজ পর্যন্ত সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। একবারও লোকসভায় কোনো আসন জেতেনি। বুথফেরত জরিপ অনুযায়ী, এবার নাকি তারা ওই রাজ্যে ২–৩টি আসন পেতে পারে। এই রাজ্য থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কংগ্রেস নেতা শশী থারুর। বুথফেরত জরিপের রায়ে তিনি বিস্মিত।
এক সাক্ষাৎকারে শশী থারুর বলেন, ‘ফল দেখে আমি স্তম্ভিত। তাজ্জব বনে গেছি। রহস্যজনক কোনো ম্যাজিক ছাড়া এই ফল সত্য হতে পারে না।’
কংগ্রেসের এই নেতা বলেন, ‘জরিপকারী সংস্থাগুলো প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি করেছে। সব আসন বিজেপিকে দিয়ে রেখেছে। অথচ জমিনি বাস্তবতা তা নয়। বিজেপি কেরালা থেকে একটাও আসন জিতবে না। একই অবস্থা তামিলনাড়ুতেও।’
শশী অবশ্য স্বীকার করেছেন, ওই দুই রাজ্যে বিজেপির ভোট শেয়ার কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু তা অত আসন দিতে পারে না।
আগামীকাল মঙ্গলবার সারা দেশের ভোট গণনা। তার আগে আজ সোমবার নির্বাচন কমিশন সংবাদ সম্মেলন করেছে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার বলেন, ভোট গণনায় কোনো ভুল বা কারচুপির অবকাশ নেই। ৩০–৩৫ লাখ পোলিং এজেন্ট থাকবেন। গণনাকারী কর্মকর্তারা থাকবেন। নজরদারি দল থাকবে। সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা গত রোববার যা যা দাবি করেছিলেন, সব মেনে নেওয়া হয়েছে।