১৩ মে অনুষ্ঠেয় চতুর্থ দফার নির্বাচনের আগে অন্তত এমন ঘটনা দুটি ঘটে গেল, যার জেরে অধিকাংশ বিজেপি নেতা এখন আর মনে করছেন না, পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯ সালের ফলের মতো ফল করতে পারবে বিজেপি। ২০১৯ সালে রাজ্যে ৪২ আসনের মধ্যে ১৮টি পেয়েছিল বিজেপি। এবারও তাদের শুরুটা ভালোই হয়েছিল। কিন্তু গত এক সপ্তাহে পরপর দুটি ঘটনা তৃণমূলকে অনেকটাই সুবিধা করে দিয়েছে।
সন্দেশখালীর তিন নারী, যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের একজন অভিযোগ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। কথিত মিথ্যা ধর্ষণের অভিযোগ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের কারণে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই অভিযোগ এনে কথিত ওই নির্যাতিত নারী উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার সন্দেশখালী থানায় নতুন অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগে ওই নারী উল্লেখ করেন, স্থানীয় বিজেপির নারী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও অন্য সদস্যরা তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁকে দিয়ে একটি কাল্পনিক অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়েছে।
অভিযোগপত্রে ওই নারী লিখেছেন, ‘তাঁরা (বিজেপির কর্মীরা) প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনাতে আমার নাম নথিভুক্ত করার অজুহাতে আমার স্বাক্ষর চেয়েছিল। পরে তাঁরা আমাকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করতে থানায় নিয়ে যায়। তৃণমূল অফিসের ভেতরে আমার ওপর কোনো যৌন হেনস্তা হয়নি। আমাকে কখনোই গভীর রাতে পার্টি অফিসে যেতে বাধ্য করা হয়নি।’
পাশাপাশি আজ বৃহস্পতিবার সকালে বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্রের একটি ভিডিও প্রকাশ্যে এনেছে তৃণমূল কংগ্রেস। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিজেপির প্রার্থী রেখা পাত্রকে যখন এক সাংবাদিক গোপন ক্যামেরায় তোলা ভিডিওগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করছেন, তখন তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে সরে যাচ্ছেন। তৃণমূল বলছে, বিজেপি আর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।
সন্দেশখালীতে তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, গ্রামের একাধিক নারীকে তাঁরা ধর্ষণ করেছেন। গত এক সপ্তাহে একাধিক ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে, যেখানে সন্দেশখালী গ্রামের নারীরা বলছেন, তাঁদের জোর করে বা কখনো টাকা দিয়ে এই ভিডিওগুলোয় মিথ্যা বলতে বাধ্য করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ায়।
সন্দেশখালীর এই আন্দোলনের প্রধান নেত্রী ছিলেন রেখা পাত্র। পরে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁকে বসিরহাটের প্রার্থী করে। সন্দেশখালী বসিরহাটের অন্তর্গত।
তৃণমূল কংগ্রেস এখন দিল্লিতে এবং পশ্চিমবঙ্গে বিষয়টিকে বড় ইস্যু করার চেষ্টা করছে। তারা বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং অন্যদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করবে বলেও জানিয়েছে।
তৃণমূলের দলীয় সূত্রে বলা হয়েছে, গোপন ক্যামেরায় তোলা ভিডিওতে দেখা গেছে, সন্দেশখালীতে বিজেপির মণ্ডল সভাপতি গঙ্গাধর কয়াল বলছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারী “পুরো ঘটনার পেছনে ছিলেন, তিনি এই ষড়যন্ত্র করেছেন।”’
ভারতের জাতীয় স্তরের প্রচারমাধ্যম এখনো গোপন ক্যামেরায় তোলা নারীদের জবানবন্দি বড় করে প্রচার না করলেও পশ্চিমবঙ্গের প্রচারমাধ্যম বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে প্রচার করছে। পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে যখন ৩২টি আসনে নির্বাচন বাকি, তখন বিষয়টি একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে সামনে চলে এসেছে। তৃণমূলও লাগাতার নারীদের অপমানের বিষয়টিকে সামনে আনার চেষ্টা করছে। রোজই নেতা-নেত্রীরা এ নিয়ে কথা বলছেন।
আজ বৃহস্পতিবার তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য সাকেত গোখলে বলেছেন, ‘বিজেপির মুখোশ খুলে গেছে। তারা যে জোর করে নারীদের দিয়ে ভুয়া ধর্ষণের মামলা করিয়েছিল, তা আজ প্রকাশ্যে এসেছে। যেসব সংবাদমাধ্যম বিষয়টিকে নিয়ে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, জানতে ইচ্ছে করে তারা আজ কোথায়?’
আজ বৃহস্পতিবার সকালে বিষয়টি নিয়ে বিজেপিকে আক্রমণ করে বিবৃতি দিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য সুস্মিতা দেব, সাগরিকা ঘোষ, ডেরেক ও’ব্রায়ান প্রমুখ।
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেছেন, বিজেপির নাটক সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা নারীদের হুমকি দিচ্ছে, যাতে তাঁরা মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহার করতে না পারে। তৃণমূল কংগ্রেস পুরো পরিস্থিতির ওপরে নজর রাখছে।
এ ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মুখ ধ্রুব রাঠি। তিনি লিখেছেন, মিথ্যা অপপ্রচার একের পর এক সামনে আসতে শুরু করেছে।
বিষয়টি যে বিজেপির ওপর ক্রমেই চাপ বাড়াচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গতকাল বুধবার রাতে এক অনুষ্ঠান শেষে গাড়িতে ওঠার সময় রাজ্য বিধানসভায় বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী মাথা গরম করে আপত্তিকর কথাবার্তা বলেন। সন্দেশখালীতে গোপন ক্যামেরায় তোলা চিত্রে দেখা গেছে, বিজেপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, শুভেন্দুই তাদের দিয়ে এসব অভিযোগ করিয়েছিলেন।
বিজেপির এক প্রার্থী প্রথম আলোকে বৃহস্পতিবার বলেন, ‘সন্দেশখালীতে যে অভিযোগ করা হয়েছিল এবং পরে যা ঘটল, তাতে আমাদের ওপর কিছুটা চাপ বেড়েছে। আমাদের নেতৃত্বের উচিত, এই ভিডিওতে যা প্রকাশ্যে এসেছে, তা খণ্ডন করে বক্তব্য প্রচার করা। দলের তরফে সেটা করা হচ্ছে। তবে আমাদের এটাও দেখতে হবে, কেন এই নারীরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করছেন। তাঁরা তৃণমূলের নতুন কোনো চাপে পড়ে বিবৃতি দিচ্ছেন কি না, সেটাও দেখতে হবে।’
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার আগেই বলেছিলেন, ‘স্টিং অপারেশন ভুয়া।’ এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বানানো বলে তাঁর দাবি। তবে বিষয়টি যে এ মুহূর্তে তৃণমূলকে নির্বাচনের লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে, তা অস্বীকার করছেন না বিজেপির নেতা-কর্মীরাও।
আরও একটি বিষয় তৃণমূলের সুবিধা করে দিয়েছে। আর তা হলো সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশ। সম্প্রতি এই নির্দেশে বলা হয়েছে, আপাতত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া যাবে না। তাঁদের দোষ নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হলে তবেই তাঁদের চাকরি থেকে সরানো যাবে এবং অতীতের বেতন ফেরত দিতে বলা যাবে।
এর আগে কলকাতা হাইকোর্ট ২৩ হাজার ১২৩ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতীতের বেতনও ফেরত দিতে বলেছিলেন। চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে, এই অভিযোগে তাঁদের বরখাস্ত করা হয়েছিল। এই নির্দেশটিকেই কার্যত খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
তৃণমূল কংগ্রেস এই নির্দেশকেও বড় জয় হিসেবে দেখছে। অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের বিষয়টি সন্দেশখালীর মতো বড় ইস্যু হিসেবে প্রচার করছে না তৃণমূল।
সম্ভবত এর কারণ, সন্দেশখালীতে নারীদের ধর্ষণ রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে একটি প্রধান ইস্যু হিসেবে সামনে এসেছিল। নির্বাচনের সময় প্রবল রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই তৃণমূল এখন তাদের প্রচারে সন্দেশখালীর ওপর জোর দিচ্ছে।