র‍্যাট হোল মাইনার্স শ্রমিক ওয়াকিলের দিল্লির বাড়িটি গতকাল বুধবার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়
র‍্যাট হোল মাইনার্স শ্রমিক ওয়াকিলের দিল্লির বাড়িটি গতকাল বুধবার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়

সুড়ঙ্গ ধসে আটক শ্রমিকদের উদ্ধারকারী সেই ওয়াকিলের ঘর ভেঙে দিল সরকার

দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ) গতকাল বুধবার উত্তরাখন্ডে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারকারী র‍্যাট হোল মাইনার্স দলের সদস্য ওয়াকিল হাসানের ঘর ভেঙে দিল। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে হতবাক হাসানের খেদোক্তি, মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম। এই তার পুরস্কার।

ওয়াকিল হাসান ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বেশ কয়েক দিন হইচই হয়েছিল সারা দেশে। কেননা, দেশ–বিদেশের বিশেষজ্ঞরা যখন ব্যর্থ, বিদেশ থেকে আনা মেশিন যখন ভেঙে গেছে, হাসানের সঙ্গীরাই তখন উত্তরাখন্ডের সুড়ঙ্গে ভূমি ধসে আটকে পড়া ৪১ শ্রমিককে উদ্ধার করেছিলেন। তাঁদের নতুন জীবন দান করেছিলেন। গোটা দেশ তখন তাঁদের মাথায় তুলে নেচেছিল। ধন্য ধন্য করেছিল।

হাসান ও তাঁর সঙ্গীদের পরিচয় যৎসামান্য। তাঁদের পোশাকি নাম কেউ মনে রাখেনি। সবাই তাঁদের ‘র‌্যাট হোল মাইনার্স’ বা ইঁদুর সুড়ঙ্গ শ্রমিক বলে জেনেছিল। ইঁদুর যেমন ছোট ছোট গর্ত খোঁড়ে, সেই রকম একজন মানুষ কোনোরকমে যেতে–আসতে পারে, এমন সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এই শ্রমিকেরা খনি থেকে কয়লা সংগ্রহ করতেন। সেই কাজ নিষিদ্ধ হয়েছে বহুদিন।

তবে সুড়ঙ্গ ধসে আটক শ্রমিকদের উদ্ধারে সরকার শেষ পর্যন্ত তাঁদের সেই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাসানের সঙ্গীরা সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করেছিলেন অক্ষত অবস্থায়। দিল্লিতে সেই হাসানের ঘরবাড়ি গতকাল বুধবার ডিডিএ বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দিল।

উত্তর–পূর্ব দিল্লির খাজুরি খাস এলাকায় ওয়াকিল হাসানের বসবাস। ডিডিএর অভিযোগ, তাঁর ঘরবাড়ি বেআইনিভাবে তৈরি হয়েছিল সরকারি জমিতে। ডিডিএ আইন মেনে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে। হাসান ও এলাকার অন্য বাসিন্দাদের দাবি, উচ্ছেদের কোনো নোটিশই তাঁদের দেওয়া হয়নি। আগে থেকে চলে যাওয়ার কোনো সুযোগও দেওয়া হয়নি।

হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, কর্তৃপক্ষ তাঁদের ঘর ভাঙার কাগজপত্রও দেখাতে পারেনি। প্রশ্ন করায় তাঁদের থানায় আটকে রাখা হয়। তিনি ও তাঁর বাচ্চাদের মারধরও করা হয়েছে। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর এটাই পুরস্কার! মরা ছাড়া এখন আর কোনো উপায় তাঁদের নেই।

হাসানের সঙ্গে উত্তরাখন্ডের সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গে উদ্ধারকাজে গিয়েছিলেন মুন্না কুরেশি। হাসানের সুরে সুর মিলিয়ে তিনিও বলেন, সরকার বলেছিল, এর পর থেকে আর কাউকে এমন কাজ করতে হবে না। আমরা ঘরে বসে থাকতে পারব। হাসানের সেই ঘরটাই সরকার কেড়ে নিল।

ডিডিএ অবশ্য বলেছে, যা হয়েছে আইন মেনেই। উচ্ছেদের নোটিশ আগেই পাঠানো হয়েছে। সবাইকে জানানো হয়েছিল জায়গা খালি না করলে সরকার তা জোর করে খালি করে দেবে। ডিডিএ কর্তৃপক্ষের দাবি, দখল হওয়া জায়গা উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত হবে।

গত বছরের নভেম্বরে নির্মাণাধীন সুড়ঙ্গে ধসের পর ৪১ শ্রমিক টানা ১৭ দিন আটকে ছিলেন। বিদেশি যন্ত্র ভেঙে যাওয়ার পর আরও এক মাস আটকে থাকতে হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা যখন আশঙ্কা করছিলেন, সে সময়েই ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছিলেন দিল্লির বকিল হাসান, মুন্না কুরেশিদের মতো ১২ র‌্যাট হোল মাইনার্স।

১২ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উত্তরাখন্ডে। উদ্ধারকাজ শেষ হলে তাঁদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। হাসান–কুরেশিরা তাঁদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন, যাতে তাঁদের পরের প্রজন্মকে এই পেশায় থাকতে না হয়।

বিজেপিশাসিত উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি তাঁর বাসভবনে এই শ্রমিকদের প্রত্যেকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ৫০ হাজার রুপি। তাঁরা ক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। কেননা, আটক শ্রমিকদের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছিল এক লাখ রুপি। অথচ তাঁদের দেওয়া হয় ৫০ হাজার।

পুনর্বাসনের স্বস্তি তো দূরের কথা, ভারত সরকারের নগরোন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা ডিডিএ এবার ওয়াকিল হাসানের মাথার ছাদটুকুও কেড়ে নিল। পরিবার নিয়ে এখন তিনি কোথায় যাবেন, তা জানেন না।