হিন্দুত্ববাদ প্রসারের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্দেশে বিজেপি যেসব আইন করেছে, নাগরিক সমাজে বিভাজন সৃষ্টির পাশাপাশি যা রাজ্যের অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে, কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার দ্রুত সেসব আইন পর্যালোচনা করবে। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সদস্য এ সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
সেসব আইন ও নির্দেশাবলির মধ্যে যেমন রয়েছে স্কুলে হিজাব নিষিদ্ধ বিধি, নৈতিক পুলিশ, পাঠ্যসূচির পরিবর্তন, তেমনই রয়েছে ধর্মান্তর রোধ ও গোহত্যা বন্ধের মতো আইন। কংগ্রেস সরকারের এই পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত ঘিরে রাজ্য বিজেপি সরব। কংগ্রেসের প্রতি তাদের প্রশ্ন, গোহত্যার মধ্য দিয়ে তারা শাসন শুরু করতে চাইছে কি না।
কর্ণাটকে বিজেপির গত চার বছরের শাসনকালে এসব আইন ও বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। তা নিয়ে নাগরিক সমাজে বারবার উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটেছে। রক্ত ঝরেছে। সমাজ অশান্ত হয়েছে। কংগ্রেসের বিভিন্ন মন্ত্রী বলছেন, এই জাতীয় বিভেদ বন্ধের প্রতিশ্রুতি তাঁরা নির্বাচনের আগে দিয়েছিলেন। অর্থনীতির বিকাশের অঙ্গীকার করেছিলেন। জনতার রায়ে ক্ষমতায় এসে এখন তাঁরা সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। সে জন্যই এসব আইন ও বিধিনিষেধ পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রাজ্য সরকারের যে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক সবচেয়ে বেশি, তা হচ্ছে গোহত্যা-সংক্রান্ত। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরমেশ্বর সম্প্রতি বলেন, গোহত্যা বন্ধে আগের বিজেপি সরকার প্রচলিত আইন সংশোধন করে নতুন যেসব নিয়ম তৈরি করেছিল, সরকার তা পর্যালোচনা করবে। দুটি কারণে তা প্রয়োজন বলে তিনি জানিয়েছিলেন। প্রথম কারণ, ওই আইন রাজ্যের অর্থনীতির পক্ষে সর্বনাশা। দ্বিতীয়ত, ওই আইন সমাজে বৈষম্য, বিভাজন ও অশান্তি সৃষ্টি করেছে। দরিদ্র মুসলমান, দলিত, আদিবাসী, অনগ্রসরদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। কর্মহীন করে দিয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, রাজ্যে মহিষ জবাই করা গেলে ষাঁড় ও বলদ কেন যাবে না? কেন বৃদ্ধ গরু কাটা যাবে না?
পর্যালোচনার বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়াও সমর্থন করেছেন। তিনি বলেন, রাজ্যবাসীর যাতে ভালো হবে, সরকার তা করবে। একই কথা বলেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের ছেলে এবং রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী প্রিয়াঙ্ক খাড়গে। তিনি বলেন, গোহত্যা বন্ধের আইন বিজেপি এনেছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) কর্তাদের খুশি করতে। তারা বিবেচনা করেনি, ওই আইন বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিশেষ ধরনের কিছু শিল্প পঙ্গু করে দিয়েছে। দরিদ্র মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। সামাজিক অশান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর হিসাব অনুযায়ী, গোহত্যা বন্ধের আইনের দরুন বছরে রাজ্যের আয় কমেছে ৫ হাজার ২৮০ কোটি রুপি।
রাজ্য সরকারের পক্ষে প্রিয়াঙ্ক খাড়গে সম্প্রতি এক টুইটে বলেন, বিজেপির সরকারের সেসব আইন ও নিয়ম পর্যালোচনা করা হবে, যা রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, লগ্নিতে বাধা সৃষ্টি করেছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত করছে, ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করছে এবং যা অসাংবিধানিক। একই সঙ্গে রাজ্য সরকার এই বিষয়ও স্পষ্ট করে দিয়েছে, হিন্দুত্ববাদ প্রসারের নামে অযৌক্তিক ও জবরদস্তি যা কিছু করা হয়েছে, সব পর্যালোচনা করা হবে।
এই তালিকায় পড়ছে পাঠ্যসূচির বদল। রাজ্যের পূর্বতন সরকার স্কুলপর্যায়ে ইতিহাসসহ বিভিন্ন পাঠ্যসূচির বদল ঘটিয়েছে। টিপু সুলতানকে খলনায়ক হিসেবে খাড়া করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। পাশাপাশি শুরু করা হয়েছে হিজাব-বিতর্ক। রাজ্য সরকারের তথ্য পেশ করে প্রিয়াঙ্ক খাড়গে বলেন, হিজাব-বিতর্কের কারণে ১৮ হাজার মুসলমান ছাত্রী স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সরকার শিক্ষার বিস্তার চায়। নারীদের শিক্ষিত করতে তুলতে চায়। সে জন্য এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক নির্দেশ পর্যালোচনা করা হবে।
একইভাবে পর্যালোচনা করা হবে ‘নৈতিক পুলিশ’ তৈরির বিষয়টিও। ধর্মান্তর রোখা ও এক ধর্মের নারী-পুরুষ অন্য ধর্মের প্রতি যাতে আকর্ষিত না হন, সে জন্য পুলিশের মধ্যে একটি শাখা তৈরি করা হয়।
তাদের কাজ হবে যুব সমাজের ‘নৈতিকতা’ রক্ষা করা। কংগ্রেস সরকার ওই ‘নৈতিক পুলিশ’ তুলে দিতে চাইছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরমেশ্বর বলেছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য পুলিশ বিভাগে একটি ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সেল’ খোলা হবে। নৈতিক পুলিশের কোনো প্রয়োজন নেই। ওই ব্যবস্থা মানুষকে অযথা হয়রান করছে। দুর্নীতির সহায়ক হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত স্বার্থে নৈতিক পুলিশ ব্যবহৃত হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া পুলিশের বড় কর্তাদের বলেছেন, কোথাও নৈতিক পুলিশের বাড়াবাড়ি যেন না দেখা যায়। নৈতিকতা রক্ষায় পুলিশের বাড়াবাড়ি দেখলে কর্তাদের জবাবদিহি করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সেল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করবে, যাতে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে।
উপমুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার বলেছেন, পুলিশকে অতি দ্রুত হিন্দুত্ববাদমুক্ত হতে হবে। পুলিশকে চলতে হবে ন্যায় ও আইনের পথে। ধর্মবিশ্বাস আঁকড়ে নয়।
সরকারের এসব সিদ্ধান্তের সমালোচনায় বিজেপি সরব। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই বলেছেন, কংগ্রেস চিরকাল যা করে এসেছে, এখনো তাই করছে। শুরু করে দিয়েছে তাদের মুসলমান তোষণনীতি।