ভারতের সাবেক পুলিশ (আইপিএস) কর্মকর্তা শৈলেন্দ্র শ্রীবাস্তব একটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত এই বই থেকে জানা গেছে, ২০০৫ সালে মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত দাউদ ইব্রাহিমের মেয়ের বিয়ের গাউন ও মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে একজন শিল্পপতির ছেলেকে অপহরণের যোগসূত্র ছিল। আপাতদৃষ্টিতে কিছু ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও সেসব ঘটনা কীভাবে একটি আরেকটির সঙ্গে জড়িত ছিল, লেখক তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সেই গাঁথুনি গেঁথেছেন ‘শ্যাকল দ্য স্টর্ম’ নামের বইটিতে। এর মধ্য দিয়ে দুই দশক আগে মধ্যপ্রদেশের অপরাধ জগতের কালো অধ্যায়ের বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে।
গল্পের শুরু দাউদ ইব্রাহিমের মেয়ের বিয়ের গাউন নিয়ে। গাউনটি সেলাই করেছিলেন মধ্যপ্রদেশের শিবপুরি জেলার ইসমাইল খান। এরপর সেই গাউন সৌদি আরবের মক্কায় পাঠানো হয়। ২০০৫ সালের জুলাই মাসে মক্কায় বিয়ে হয় দাউদ ইব্রাহিমের মেয়ে মাহরুখার। এর এক মাস পর ইন্দোরের এক সিমেন্ট ব্যবসায়ীর ছেলে ২০ বছর বয়সী নীতিশ নাগোরিকে অপহরণ করা হয়। মুক্তিপণ হিসেবে চার কোটি রুপি দাবি করেন অপহরণকারীরা। তবে মুক্তিপণ দেওয়ার আগেই পুলিশ নীতিশকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কয়েকজন আটক হয় পুলিশের হাতে।
তদন্তের এক পর্যায়ে জানা যায়, নীতিশ নাগোরিকে অপহরণের ঘটনায় ইসমাইল খান জড়িত। তবে এই ঘটনার পরপরই দেশ ছেড়ে পালান তিনি। ইসমাইল ছিলেন দাউদ ইব্রাহিমের অন্যতম সহযোগী আফতাব আলমের ঘনিষ্ঠ। নীতিশ নাগোরির জন্য যে অপহরণকারী মুক্তিপণ দাবি করেছিলেন, সেখান থেকে একটি অংশ দাউদ ইব্রাহিমের পাওয়ার কথা ছিল বলে জানা যায়।
সেই ঘটনার পর দুই দশক ধরে ইসমাইল খান ও আফতাব আলম পলাতক। এরপর দীর্ঘদিন ধরে মামলাটি আড়ালে পড়ে ছিল। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা শৈলেন্দ্র শ্রীবাস্তবের বইটি প্রকাশের পর নতুন করে বিষয়টি আলোচনায় আসে।
‘আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাংস্টার’ হিসেবে পরিচিত দাউদ ইব্রাহিম ভারত সরকারের একজন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাঁর গ্রামের বাড়ি মহারাষ্ট্রের রত্নগিরির মুমবেক। সেখান থেকে তিনি ১৯৮৩ সালে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান। মুম্বাইয়ে ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চের ধারাবাহিক বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী মনে করা হয় দাউদ ইব্রাহিমকে। এই বোমা হামলায় ২৫৭ জন নিহত হন। আহত হন সাত শতাধিক মানুষ। এরপরই দেশ ছেড়ে পালান দাউদ ইব্রাহিম। তিনি দীর্ঘদিন পাকিস্তানের করাচিতে আত্মগোপনে আছেন বলে অভিযোগ করে আসছে ভারত। তবে পাকিস্তান বরাবরই ভারতের এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
অপহরণ নাকি অপহরণের নাটক
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট নীতিশ নাগোরিকে অপহরণ করা হয়। অপহরণে ইসমাইল খানকে সহযোগিতার অভিযোগে পরের মাসে ধ্রুব নামে নীতিশের এক বন্ধু ও গৌরব নামে আরও এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ধ্রুব তাদের জানিয়েছিল নীতিশ নাগোরিকে অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ইসমাইল খান।
অপহরণের এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়েই পুলিশ জানতে পারে দাউদ ইব্রাহিমের মেয়ে মাহারুখের বিয়ের গাউনটির কারিগর ছিলেন ইসমাইল খান এবং আফতাব আলমের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে। পাশাপাশি এই গাউন তৈরির মজুরি হিসেবে তাঁকে এক কোটি রুপি দেওয়ার কথা বলা হয়।
পুলিশ জানতে পারে, ১৯৯৭ সালে মুম্বাই থেকে পালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে যান আফতাব আলম। সেখান থেকেই নিতীশকে অপহরণের কলকাঠি নাড়েন তিনি। এই কাজটি করে দেওয়ার জন্য ইসমাইলকে দুবাইয়ে চাকরির লোভ দেখানো হয়। পাশাপাশি দিতে চাওয়া হয় মোটা অঙ্কের অর্থ।
পুলিশের ধারণা, অপহরণের জন্য ইসমাইল খানকে বিপুল অর্থ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়।
২০১০ সালে ইন্দোরের একটি আদালত এই মামলায় অভিযুক্ত আমজাদ খান, ইদ্রিস খান ও মনিষকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া অভিযুক্ত হিসেবে ধ্রুব, গৌরব ও অন্য যাঁরা ছিলেন, তাঁদের খালাস দেন। আমজাদ ও ইদ্রিসকে ২০২০-২১ সালে জামিন দেওয়া হয়।
ইসমাইল খান ছাড়াও এই মামলার আরও দুই অভিযুক্ত দাউদ ইব্রাহিম ও রান্ধওয়া কখনো ধরা পড়েননি। শ্রীবাস্তব লিখেছেন, ‘তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। আফতাবের বিরুদ্ধে জারি গ্রেপ্তারি পরোয়ানার একটি অনুলিপি ইন্টারপোলে পাঠানো হয়ছিল। ইসমাইল এ ঘটনার পর পালিয়ে মুম্বাইয়ে থাকেন কিছুদিন। এরপর সেখান থেকে তিনি দুবাই চলে যান বলে ধারণা করা হয়।’
২০০৫ সালে ভারতীয় পুলিশের ইন্দোর রেঞ্জের মহাপরিদর্শক (আইজি) শ্রীবাস্তবের তথ্যমতে, অপহরণের এ মামলায় একটি চমকপ্রদ মোড় নেয় যখন জানা যায় ভুক্তভোগী তরুণ নিজেই তাঁর বন্ধুকে নিয়ে অপহরণের এই পরিকল্পনা করেন। আর এই মামলার তদন্ত করতে গিয়েই ইন্দোর পুলিশ দাউদ ইব্রাহিম ও ছোটা রাজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং মধ্যপ্রদেশে তাঁদের গোপন কার্যকলাপেরও তথ্য পায়।
ভিকি নাকি বিজয়
২০০৪ সালে ছোটা রাজনের চক্রের সদস্য ভিকি মালহোত্রা থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে ইন্দোরে এক মদ ব্যবসায়ীকে ফোন দিয়ে ৪ কোটি রুপি দাবি করেন। এই অর্থ দেওয়া না হলে তাঁকে অপহরণ করা হতে পারে বলেও হুমকি দেন তিনি। এরপর ওই ব্যবসায়ী পুলিশকে ফোন করে ওই মোবাইল নম্বরটি দেন। এই ঘটনার কথা স্মরণ করে শ্রীবাস্তব তাঁর বইয়ে লিখেছেন, পুলিশ এ ঘটনায় মামলা করলেও প্রাথমিকভাবে সেই নম্বরটির গুরুত্ব বুঝতে পারেনি।
তবে পরে ইন্দোর পুলিশ সেই মুঠোফোন নম্বরটি মুম্বাই পুলিশকে দেয় এবং নম্বরটি নজরদারিতে রাখা হয়। ২০০৫ সালে মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতির সময় অসাবধানতাবশত এই মামলায় জড়িয়ে পড়েন দাউদ ইব্রাহিম। ভিকি মুম্বাইয়ে এসে এই নম্বরটি চালু করলে পুলিশ টের পেয়ে যায় এবং তাঁকে দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার করে।
শ্রীবাস্তব টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘আমি তখন ইন্দোরে আইজি। ভিকির গ্রেপ্তার হওয়ার খবরটি জানার পর মুক্তিপণ দাবিসংক্রান্ত মামলাটি আবার চালু করি। আদালত থেকে পরোয়ানা নিয়ে আমি তাঁকে ইন্দোরে নিয়ে আসি। তাঁকে ব্যাপক নির্যাতন করা হবে এমন ভয়ের মধ্যে ছিলেন ভিকি। কিন্তু আমরা তাঁর কাছ থেকে সহযোগিতা পেতে তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। আস্থা অর্জনে তাঁকে খাবার ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সুযোগ করে দিয়েছিলাম।’
দাউদ ইব্রাহিমকে হত্যার চেষ্টা
পুলিশের সাবেক এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের মধ্যকার আলাপ-আলোচনায় ভিকি তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করেন। আমাদের তিনি জানান, তাঁর নাম আসলে বিজয় কুমার যাদব। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। সে সেময় তিনি অপরাধ জগতের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়ে বিস্তারিত খুলে বলেন। কীভাবে তিনি ছিঁচকে চোর থেকে ছোটা রাজন চক্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন, সেই গল্পও বলেন। এমনকি দাউদকে হত্যাচেষ্টায় তাঁর সম্পৃক্ততাসহ নিজের অপরাধমূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান।’
একাধিকবার দাউদ ইব্রাহিমকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে জানিয়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন ভিকি। এর মধ্যে একটি পরিকল্পনা ছিল করাচিতে দাউদের মেয়ের দাফনের সময় তাঁকে হত্যা করা হবে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। এ ছাড়া দুবাইয়ে ইন্ডিয়া ক্লাবে একবার এক সহযোগীকে নিয়ে দাউদের ওপর হামলার চেষ্টা করেছিলেন জানিয়ে সেই নাটকীয় ঘটনার বর্ণনাও দেন ভিকি। কিন্তু সেদিন দাউদকে তাঁরা সেখানে দেখতেই পাননি বলে তাঁদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।
শ্রীবাস্তব ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের (আইপিএস) ১৯৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তা। মধ্যপ্রদেশ পুলিশে ৩৪ বছর দায়িত্ব পালন শেষে সম্প্রতি তিনি অবসরে যান। সর্বশেষ তিনি মধ্যপ্রদেশ পুলিশ গৃহায়ণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন করপোরেশনে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে রাজনন্দগাঁওয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) ছিলেন তিনি। তখন এক শীর্ষ মাওবাদী নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন শ্রীবাস্তব। ২০০৬ সালে ভোজশালা দাঙ্গার সময় ইন্দোর রেঞ্জে আইজি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন শ্রীবাস্তব। সেখানে তিনি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সামাল দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
‘শ্যাকল দ্য স্টর্ম’ বইটি অপরাধ জগতের টান টান উত্তেজনার গল্পের চেয়ে বেশি কিছু। এটি এমন ১৪টি আকর্ষণীয় গল্পের সংকলন।