ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে বিজেপির তুরুপের তাস ছিল বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের ফল দেখাল, সেই তাস বিজেপিকে তরাতে পারল না। সর্বশক্তি নিয়োগ করেও মুখ থুবড়ে পড়ল বিজেপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট। ৮১ আসনের বিধানসভায় ইন্ডিয়া জোট ৫৬টি আসন দখল করতে চলেছে আর বিজেপি ২৪ আসন । দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার নেতা হেমন্ত সরেন। রাজ্য গঠনের পর এই প্রথম এমনটা ঘটতে চলেছে।
ঝাড়খন্ডে বিজেপি পর্যুদস্ত হলেও মহারাষ্ট্রে আরও বেশি আসন জিতে ক্ষমতা ধরে রাখছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন মহায়ুতি। কংগ্রেস, শিবসেনা (উদ্ধব) ও এনসিপির (শরদ পাওয়ার) ইন্ডিয়া জোটকে ধরাশায়ী করেছে বিজেপি ও এর জোটসঙ্গীরা। এই জয়ের পর এ বিষয়েও আর কোনো সংশয় থাকছে না, শিবসেনা ও এনসিপির রাশ প্রশ্নাতীতভাবে থাকছে যথাক্রমে একনাথ শিন্ডে ও অজিত পাওয়ারের হাতে।
এ জয়ের পর মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদের বড় দাবিদার হতে চলেছেন বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফডনবিশ। ২৮৮ আসনের বিধানসভায় মহায়ুতি জিততে চলেছে ২২৩ আসন। বিজেপি একাই জিততে চলেছে ১২৫ আসন। বিজেপির মিত্র শিবসেনা (শিন্ডে) এগিয়ে রয়েছে ৫৭ ও অজিত পাওয়ারের এনসিপি ৩৭ আসনে।
ইন্ডিয়া জোটের কাছ থেকে ঝাড়খন্ড ছিনিয়ে নিতে বিজেপি চেষ্টার কসুর করেনি। ভোটের আগে থেকেই তারা ঠিক করেছিল, বাংলাদেশ থেকে ‘মুসলমান অনুপ্রবেশকে’ প্রধান হাতিয়ার করে তুলবে। সেই লক্ষ্যে নির্বাচন ঘোষণার আগেই বিষয়টি তারা বড় করে তুলে ধরেছিল। ঝাড়খন্ডের গোড্ডা লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী বিজেপি সদস্য নিশিকান্ত দুবে সংসদে এ বিষয়ের অবতারণা করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ঢুকে মুসলমানরা ঝাড়খন্ডের আদিবাসী–অধ্যুষিত এলাকার জনবিন্যাসে বদল ঘটিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার অনুপ্রবেশের প্রশ্ন নিয়ে সরব হয়েছিলেন। মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন ‘বেটি, রোটি, মাটি’ বাঁচানোর। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা ঝাড়খন্ডে ঢুকছে। সেখানকার আদিবাসী নারীদের বিয়ে করছে, রাজ্যের মানুষদের রুটিতে ভাগ বসাচ্ছে ও আদিবাসীদের জমি ছিনিয়ে নিচ্ছে। এভাবে তারা জনবিন্যাসেও বদল ঘটাচ্ছে।
অথচ এই প্রচার আদিবাসী সমাজের সমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেনকে কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে ব্যুমেরাং হয়েছে। কারাগারে যাওয়ার আগে হেমন্ত মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আরেক আদিবাসী নেতা চম্পাই সরেনকে। মুক্তি পাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে নিলে চম্পাইকে বিজেপি দলে টেনে নেয়। কিন্তু তাতেও আদিবাসী সমাজের ভোটে ভাগ বসাতে তারা ব্যর্থ। কারাগারে থাকাকালে হেমন্তর স্ত্রী কল্পনা দলের হাল ধরেছিলেন। এবারের ভোটে নারী সমর্থনও গেছে ইন্ডিয়া জোটের পক্ষে।
মহারাষ্ট্রে বিজেপির জয় যত চমকপ্রদ, ততটাই বিস্ময়কর ইন্ডিয়া জোটের বিপর্যয়। গত জুনে লোকসভা ভোটে কংগ্রেসসহ ইন্ডিয়া জোট চমৎকার ফল করলেও বিধানসভা ভোটে তারা ধরাশায়ী হতে যাচ্ছে। এর একটা প্রধান কারণ ‘মুখ্যমন্ত্রী মাঝি লাডকি বহেন যোজনা’, যা দেশে প্রথম চালু করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘লক্ষ্মীশ্রী’ নামে। প্রকল্পের লক্ষ্য নারীদের মাসে মাসে কিছু টাকা পাইয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর করে তুলতে সাহায্য করা।
জুনে লোকসভা ভোটে খারাপ ফলাফল করার পর গত জুলাইয়ে এই যোজনা চালু করেন মুখ্যমন্ত্রী শিন্ডে। ২১ থেকে ৬৫ বছর বয়স্ক নারীদের মাসে দেড় হাজার রুপি করে দেওয়া এই প্রকল্পের মূল কথা। নভেম্বরে ভোটের আগে এই অর্থ নিয়মিত নারীদের ব্যাংক হিসাবে দেওয়া হয়। অভিযোগ, সে কারণে হরিয়ানার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের ভোট করানো হয়নি। এ প্রকল্প নারীদের সমর্থন ঢেলে দিয়েছে মহায়ুতিকে। এর মোকাবিলায় বিরোধী ইন্ডিয়া জোট কিছু করতে পারেনি।
মহায়ুতির সাফল্যের অন্য কারণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা। লোকসভা ভোটে সংঘ সক্রিয় ছিল না। বিজেপিকে সে জন্য ভুগতে হয়েছে। এবার শুধু সক্রিয়ই নয়, তিন জোটকে এক রাখার চেষ্টাও সংঘ করেছে। তৃতীয় কারণ, ভোটের আগে বিজেপির তোলা ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ স্লোগান, যার সারার্থ, হিন্দুসমাজ জোটবদ্ধ না হলে মুসলমানদের ছোবল খেতে হবে।
ইন্ডিয়া জোটের অভিযোগ, সর্বোপরি মহারাষ্ট্রের লড়াই অসম করে তুলেছে অর্থের খেলা। শাসকগোষ্ঠীর অর্থবলের মোকাবিলা ইন্ডিয়া জোট করতে পারেনি। অভিযোগ যা–ই হোক, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, কংগ্রেস, শিবসেনা (উদ্ধব) ও এনসিপি (এসপি) নিজেদের জোটবদ্ধ করে আসন–সমঝোতার মাধ্যমে শাসক জোটের মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। স্থানীয় বিষয়ের ওপর জোর না দিয়ে কংগ্রেস সংবিধান, জাত গণনা, মোদি, আদানি প্রসঙ্গ বড় করে তুলে ধরেছিল। মহারাষ্ট্রের জনতা তা শোনেনি।
মহারাষ্ট্রের ভোটের ফল অনেক কিছুর মধ্যে এটাও প্রমাণ করল, হরিয়ানার ব্যর্থতা থেকে কংগ্রেস শিক্ষা নেয়নি। ঝাড়খন্ডের ফল দেখাল, শক্তিশালী আঞ্চলিক দল এখনো বিজেপির সাম্রাজ্য বিস্তারের পথের কাঁটা।