ভারতের ওডিশা রাজ্যের বালাসোরের বাহানাগা স্টেশন এলাকায় গত শুক্রবার সন্ধ্যায় তিন ট্রেনের দুর্ঘটনায় তৈরি হয় এক মর্মান্তিক বাস্তবতার। দ্রুতগতির ট্রেনের বগিগুলো উল্টে পড়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ২৮৮ জন। রাতে লাশগুলো উদ্ধার করে নেওয়া হয়েছিল স্থানীয় একটি স্কুলপ্রাঙ্গণে। সেখানে কী পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, কীভাবে স্বজনেরা প্রিয়জনের লাশ খুঁজে পেয়েছেন, তা তুলে ধরেছেন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর প্রতিবেদক সত্যসুন্দর বারিক। প্রতিবেদনটি বাংলা করে প্রকাশ করা হলো।
শুক্রবার দিবাগত রাত প্রায় দুইটা। বাহানাগাবাজার রেলওয়ে স্টেশন। এর কয়েক ঘণ্টা আগে এই স্টেশন এলাকায় ঘটে গেছে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। উল্টে যাওয়া ট্রেনের কামরাগুলো থেকে সারি সারি লাশ বের করে আনা হচ্ছে। এরপরে সেগুলো তোলা হচ্ছে ছোট আকারের ট্রাকে। আমি এ দৃশ্য দেখে বুঝতে পারছিলাম না লাশগুলো কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!
লাশগুলো কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার খোঁজ করতে করতে আমি এমন জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম, অনেকে ধারণা করতে পারেন, হয়তো সেগুলো সংরক্ষণ করার জন্য সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু না, জায়গাটি হলো বাহানাগা উচ্চবিদ্যালয়। গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষে আর দুই সপ্তাহ পর বিদ্যালয়টি খুলে দেওয়া হবে। শুরু হবে পাঠদান। এই দৃশ্য দেখে আরও উৎসাহী হলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, লাশগুলোর পরিণতি কী হতে যাচ্ছে? এই উৎসাহ থেকেই বিদ্যালয়ে প্রবেশ করি।
যখন আমি সংবাদ সংগ্রহের কাজে ভেতরে যাই, তখন অস্থায়ী লাশঘরে রূপান্তরিত বাহানাগা উচ্চবিদ্যালয়ে রুদ্ধশ্বাস এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। নিথর দেহগুলো স্কুলঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে। লাশগুলো থেকে একের পর এক মুঠোফোনে রিংটোন বাজতে শুনে বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি নিশ্চিত, প্রিয়জনেরা হয়তো তাঁদের স্বজনের খোঁজে মরিয়া হয়ে অবিরত কল করে যাচ্ছেন।
ছুটি শেষে খুলে দেওয়ার পর হয়তো স্কুলটি আবার শিক্ষার্থীদের কলরবে মুখর হয়ে উঠবে। কিন্তু এই নিরাশার এবং নিদারুণ যন্ত্রণার মুহূর্ত হয়তো স্কুলের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের তাড়া করে ফিরবে। মর্মান্তিক এ ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে ঘুমন্ত শহর বাহানাগা হঠাৎ জাতীয়ভাবে আলোচনায় উঠে আসে। কিন্তু খুব কম লোকই চাইবেন, এমন কোনো কারণে তাঁর শহর আলোচনায় আসুক।
হতাশ স্বজনেরা যখন মরিয়া হয়ে তাঁদের পরিচিতজনদের শনাক্তের জন্য লাশের স্তূপগুলো খুঁজে খুঁজে দেখছিলেন, তখন মুঠোফোনের এই রিংটোন স্বজনের লাশ শনাক্তে সাহায্য করেছিল তাঁদের।
এই ভাগ্যবানদের একজন পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আসিতি মৈতি। কারণ, নিখোঁজ স্বজনকে শনাক্ত করতে তাঁর খুব কষ্ট করতে হয়নি। মুঠোফোনের রিংটোন তাঁর কষ্ট কমিয়ে দেয়।
আসিতি মৈতি বলেন, ‘আমার গ্রামের পাঁচজন ছিলেন করমন্ডল এক্সপ্রেসে। এর মধ্যে একজন ভোলানাথ গিরি। তিনি ওই ট্রেনে করে চেন্নাই যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার খবর শুনে আমাদের গ্রাম থেকে কিছু মানুষ বাহানাগা আসেন আমাদের পাঁচ ঘনিষ্ঠ বন্ধুর খোঁজ করতে। আমি যখন মুঠোফোনে কল করা শুরু করি, তখন অপরিচিত একজন কলের উত্তর দেন। এরপর তিনি আমাকে ভোলার লাশ দেখিয়ে দেন।’
দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন সুরেন্দ্র রাউত নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা। তিনি বলেন, শুক্রবার রাত আনুমানিক তখন সাড়ে আটটা। ট্রেনের উল্টে যাওয়া কামরায় থাকা যাত্রীদের অনেকের মুঠোফোন তখনো সচল। এসব মুঠোফোন থেকে অবিরাম রিংটোনের শব্দ আসছিল।
দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। সুরেন্দ্র রাউতেরা যখন দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছান, তখন পুরোদমে চলছে উদ্ধার অভিযান। এ সময় লাশের কাছে যাওয়াটা ছিল তাঁদের জন্য অনেক কঠিন একটা কাজ। ট্রেনের বগিগুলো চারপাশে উল্টে পড়ে আছে। ওডিশা ডিজাস্টার র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স, ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স ও ওডিশা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উল্টে যাওয়া ট্রেনের বগিগুলো থেকে লাশ বের করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।
বালাসোরের সত্য সাই সেবা সংগঠনের একজন সদস্য নীহাররঞ্জন বলেন, ‘আমরা দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৭০টির বেশি লাশ বাহানাগা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে এত লাশ দেখে আমরা হতবাক হয়ে যাই। তবে সময় যত গড়ায় আবেগও তত কমতে থাকে এবং এরপরে আমরা ভাবলেশহীনভাবে লাশগুলো নিয়ে যেতে থাকি।’