মোদির মুখ খোলাতেই অনাস্থা প্রস্তাব

মণিপুর রাজ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মৌনতা ভাঙতেই বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে বাধ্য হয়েছে। মঙ্গলবার লোকসভায় বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে আসামের কংগ্রেস সদস্য গৌরব গগৈ বলেন, এ ছাড়া তাঁদের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না।

প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে গৌরব গগৈ বলেন, উনি সংসদে মুখ না খোলার পণ করেছেন। অথচ তিন মাস ধরে মণিপুর জ্বলছে। প্রধানমন্ত্রী ‘এক দেশ’-এর বড়াই করেন, অথচ তাঁর দলের ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার দুটি মণিপুর সৃষ্টি করে দিয়েছে। একটা মণিপুর সমতলে, অন্যটা পাহাড়ে।

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী লোকসভার সদস্যপদ ফিরে পাওয়ায় অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর বিতর্ক ঘিরে আরও বেশি আগ্রহ সঞ্চারিত হয়েছিল। মোটামুটিভাবে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল, রাহুলই বিতর্ক শুরু করবেন। অথচ শেষ মুহূর্তে কংগ্রেস কৌশল বদলে ফেলে। ঠিক হয়, রাহুল সভায় উপস্থিত থাকলেও বিতর্ক শুরু করবেন না। তিনি বিতর্কে অংশ নেবেন আগামী বৃহস্পতিবার, যেদিন প্রধানমন্ত্রীর জবাবি ভাষণ দেওয়ার কথা। কেন রাহুল শেষ মুহূর্তে মন বদলালেন, তা নিয়ে সরকারপক্ষের সঙ্গে বিরোধীদের কিছুক্ষণ কথা-কাটাকাটি হয়।

বিতর্ক চলাকালে সংসদ টিভিতে সরকারের কাজের খতিয়ান দেখানোর বিরোধিতা করেন বিরোধীরা। ফলে মিনিট দশেক বিতর্ক স্থগিত থাকে। শেষ পর্যন্ত স্পিকারের হস্তক্ষেপে সরকারের সেই প্রচার বন্ধ হয়।

গৌরব গগৈ বলেন, প্রধানমন্ত্রী মণিপুর নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন তিনটি কারণে। প্রথম কারণ, রাজ্য সরকার সব দিক থেকে চূড়ান্ত ব্যর্থ। সেই দায় নিতে চায় না কেন্দ্রীয় সরকার। দ্বিতীয়ত, একই রকমের ব্যর্থ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীরই অনুগত অমিত শাহ। তৃতীয়ত, ব্যর্থতার নজির স্থাপন করেছেন জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব যাঁদের হাতে তাঁরাও। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের ভুল স্বীকার করতে হবে এবং ব্যর্থতারও দায় নিতে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী চুপ।

গৌরব বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে তাঁরা তিনটি প্রশ্ন করতে চান। প্রথমত, হিল্লি-দিল্লি চষে ফেললেও আজ পর্যন্ত তিনি কেন মণিপুর গেলেন না? দ্বিতীয়ত, ৮০ দিন পর কেন মুখ খুললেন? খুললেনই যখন, তখন কেন মাত্র ৩০ সেকেন্ডের জন্য এবং তা-ও সংসদের বাইরে? তৃতীয়ত, গুজরাট, উত্তরাখন্ড, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের দু-তিনবার বদল ঘটিয়েছেন। অথচ এখনো কেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীকে বহাল রেখেছেন?

সরকারপক্ষে বিতর্কে প্রথম অংশ নেন ঝাড়খন্ডের গোড্ডা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত বিজেপি সদস্য নিশিকান্ত দুবে। তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী। কোন কোন মামলায় মা ও ছেলে জামিনমুক্ত রয়েছেন, কীভাবে বিচার বিভাগের করুণায় তাঁরা বেঁচে রয়েছেন, সোনিয়া কী করে জামাতাকে রক্ষা ও পুত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রাণপাত করছেন—এসব বলেন। তিনি বলেন, এটা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব নয়, এটা বিরোধীদের আস্থা পরীক্ষার ভোট। তাঁরা দেখতে চান, কে কে সমর্থন করছে, কারাই-বা বিরোধিতা করছে।

মণিপুর উপলক্ষ হলেও অনাস্থা প্রস্তাবে সরকারের যেকোনো নীতি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলা যায়। তৃণমূল কংগ্রেসের সৌগত রায় তাই বিরোধীদের দিকে ইডি, সিবিআইকে লেলিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনেছেন। বিজেপিকে ‘ওয়াশিং মেশিন’-এর সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, আজ যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত, বিজেপিতে যোগ দিলেই তাঁরা দুর্নীতিমুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। টাটকা উদাহরণ মহারাষ্ট্রের এনসিপি নেতা অজিত পাওয়ার।

এনসিপি নেত্রী সুপ্রিয়া সুলে বলেন, সরকার বললেই একটি বিশেষণ মনে আসে, ‘উদ্ধত’। সমাজবাদী পার্টির সদস্য ডিম্পল যাদব বলেন, বিজেপির একটাই কাজ, সারা দেশে বিভাজনের রাজনীতি ছড়িয়ে দেওয়া। মণিপুরেও তাই করছে। ডিএমকের টি আর বালু বলেন, ১৬৩ জনের মৃত্যুর পরও দেশের প্রধানমন্ত্রী নীরব। এটা শুধু বিস্ময়ই নয়, লজ্জাও।

সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ খণ্ডন করে মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেন, বিরোধীরা দেশে ভুল বার্তা দিচ্ছেন। ভুল বোঝাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ৮ হাজার বিচ্ছিন্নতাবাদী আত্মসমর্পণ করেছেন। নতুন করে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দেয়নি। সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় ৭৫ ভাগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিরোধী জোটের নাম ‘ইন্ডিয়া’ হলেও তারা ইন্ডিয়ার বিরোধিতা করে চলেছে। এর জন্য তাদের পস্তাতে হবে।

প্রত্যাশামতো বিজু জনতা দলের পিনাকি মিশ্র অনাস্থা প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ওয়াই এস আর কংগ্রেসও প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে বলে জানিয়েছে।

মঙ্গলবার বিজেপি সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘বিরোধীরা এই প্রস্তাব এনেছে নিজেদের শক্তি যাচাই করতে। ওরা দেখতে চায় জোটের সবাই এর পক্ষে কি না। তিনি বলেন, লোকসভা ভোটের আগে এই অনাস্থা প্রস্তাব এসেছে। আমাদের প্রতিটি বলেই ছক্কা হাঁকাতে হবে।’