কাশ্মীরি পণ্ডিত (হিন্দু) নীতি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতির সামাল দিতে শাসক দল বিজেপির দুই সাধারণ সম্পাদক গত রোববার জম্মু গিয়ে ধর্মঘটি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সঙ্গে দেখা করার পর উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহাকে অনুরোধ করেছেন পণ্ডিতদের রাজভবনে ডেকে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে। শুধু তা–ই নয়, জম্মুর নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং প্রকাশ্যেই উপরাজ্যপালের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে বলেছেন, ‘একজন সরকারি কর্মীরও জীবনের শঙ্কা থাকলে এক ডজন অফিস বন্ধ করে দিতে হবে। মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না।’
কেন্দ্রীয় সরকারের কাশ্মীরি পণ্ডিতনীতি কিছু দিন ধরেই জম্মু–কাশ্মীরের বিজেপি নেতৃত্বকে অস্বস্তিতে রেখেছে। সেই অস্বস্তি ক্ষোভে পরিণত হয় উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহার মন্তব্যে। গত সপ্তাহে জম্মুতে এক অনুষ্ঠানের মধ্যে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, কাশ্মীর উপত্যকায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নিযুক্ত হিন্দু পণ্ডিত কর্মীরা কাজে যোগ না দিলে তাঁদের বেতন কাটা হবে। যাঁদের যেখানে নিয়োগ করা হয়েছে, তাঁদের সেখানেই কাজ করতে হবে। কাউকে জম্মুতে বদলি করা হবে না।
নরেন্দ্র মোদির সরকার কেন্দ্রে আসীন হওয়ার পর ছয় হাজার পণ্ডিতের চাকরির বন্দোবস্ত করা হয়। তাঁদের শ্রীনগরসহ বিভিন্ন জেলা সদরে ও গ্রামে নিযুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু গত মে মাসে নতুন করে কাশ্মীরি পণ্ডিত ও পরিযায়ী হিন্দু শ্রমিকদের বাছাই হত্যা শুরু হওয়ার পর তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। সেই থেকে তাঁরা কাজে যোগ না দিয়ে জম্মুতে বদলির দাবিতে ধর্মঘট করছেন। অধিকাংশ প্রাণ বাঁচাতে জম্মুতে ফিরে এসেছেন। উপত্যকায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাও কাজে যোগ দিচ্ছেন না। উপরাজ্যপালের তাঁদের বেতন বন্ধের হুমকি দিয়েছিলেন।
উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহার হুমকি জম্মু–কাশ্মীর বিজেপিকে ফেলেছে ঘোর বিপাকে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছে, উপরাজ্যপালের বয়ানে সহানুভূতির লেশমাত্র ছিল না। বরং ছিল যুদ্ধংদেহী মনোভাব। ওই মন্তব্যের পরই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উপরাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলেন। সভাপতি জে পি নাড্ডার নির্দেশে দুই সাধারণ সম্পাদক তরুণ চুঘ ও দিলীপ সইকাই রোববার জম্মু চলে যান। সেখানে তাঁরা ধর্মঘটি সরকারি পণ্ডিত কর্মীদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রায় একই সময়ে বিবৃতি দেন জম্মু থেকে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং। উপরাজ্যপালের মন্তব্যকে কার্যত নস্যাৎ করে তিনি বলেন, মানুষের জীবন সবার আগে। জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে এক ডজন সরকারি অফিস বন্ধ করে দিতে হবে। মানুষের জীবনের সঙ্গে আপস চলে না।
উপরাজ্যপালের মন্তব্য হিন্দু প্রধান জম্মুতে বিজেপিকে ফেলেছে প্রবল অস্বস্তিতে। কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে শীত কমলে আগামী বছরের গ্রীষ্মেই জম্মু–কাশ্মীর বিধান সভার ভোট করিয়ে ফেলতে। সে জন্য কেন্দ্রের সীমানা বিন্যাস হয়ে গেছে। ভোটার তালিকাও প্রায় চূড়ান্ত। রাজনৈতিক স্বার্থে মেরুকরণের জন্য জরুরি সব কাজ প্রায় শেষ। এই সময় উপরাজ্যপালের অলটপকা মন্তব্য হিন্দু মানসিকতায় প্রবল ঘা দিয়েছে। বিজেপির এক শীর্ষ নেতা অমিত শাহকে বলেছেন, ‘উপরাজ্যপালের কথায় সহানুভূতির লেশ মাত্র ছিল না। বরং তাঁর হুমকিতে মনে হয়েছে, উপত্যকার হিন্দুরা যেন অবাঞ্ছিত। তাঁদের বলির পাঁঠা করা হচ্ছে।’ ওই নেতার কথায়, ভোটের আগে এই ধরনের নীতি ও মন্তব্য দলের পক্ষে অতীব ক্ষতিকর।
বিজেপি আরও বিপাকে পড়েছে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দাবি সমর্থন করায়। উপরাজ্যপালের মন্তব্যের পরেই পিডিপি নেত্রী বলেন, ‘অশান্তির গভীরে না গিয়ে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা না করে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাজে যোগ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে কাজে যোগ না দিলে বেতন বন্ধ করে দেওয়া হবে। প্রশাসনের উচিত পণ্ডিতদের সমস্যা তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। যতক্ষণ না পণ্ডিতেরা আশ্বস্ত হচ্ছেন ততক্ষণ তাঁদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত।’ মেহবুবা বলেন, ‘কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা বহু বছর ধরে দুর্ভোগ সহ্য করছেন। তাঁদের নতুন করে দুশ্চিন্তায় ফেলা বা আতঙ্কগ্রস্ত করার অর্থ হয় না।’
বিজেপির জম্মু–কাশ্মীর সভাপতি রবীন্দ্র রায়নাও উপরাজ্যপালের মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। মনোজ সিনহার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘হাতজোড় করে বলছি, দয়া করে পণ্ডিত নেতাদের ডাকুন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন। সমস্যা বোঝার চেষ্টা করুন। পরিস্থিতি অনুধাবন করুন ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন।’
কংগ্রেসের এক সূত্র এই প্রসঙ্গে আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, জম্মু–কাশ্মীরে হিন্দু মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমতাসীন করার স্বপ্ন সার্থক করতে বিজেপি চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। কিন্তু পণ্ডিত বিদ্রোহ সব ওলটপালট করে দিচ্ছে। গুলাম নবি আজাদকে তারা কাজে লাগাতে চেয়েছে। অথচ আজাদের দলও দ্রুত ভাঙছে। ওই নেতা বলেন, ‘এখন যা অবস্থা তাতে পণ্ডিত নীতি বদল ছাড়া উপায় নেই। হিন্দু ভোট পেতে গেলে হয় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জম্মুতে বদলি করতে হবে, নতুবা বসে বসে বেতন দিতে হবে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, দাবি সত্ত্বেও সরকারের কাশ্মীরনীতি কতটা ব্যর্থ।’
বিজেপিতে বিদ্রোহ বুঝিয়ে দিচ্ছে, কাশ্মীরি পণ্ডিতনীতি তাদের কাছে শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।