আম আদমি পার্টির (আপ) মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল হেফাজত থেকে সরকারি নির্দেশ পাঠালেন। ভারতে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল। কোনো মুখ্যমন্ত্রী গ্রেপ্তারের পর তদন্তকারী সংস্থার হেফাজতে থেকে সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। কারণ, কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে এভাবে কখনো গ্রেপ্তারও করা হয়নি। সেদিক থেকে কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার হওয়া ও হেফাজতে থেকেও মুখ্যমন্ত্রিত্ব চালিয়ে যাওয়া নজিরবিহীন হয়ে রইল।
আজ রোববার সকালে ইডি হেফাজত থেকে দিল্লির জলমন্ত্রী আতিশীকে পানি সরববাহসংক্রান্ত এক নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল পাঠান। সেই নির্দেশ পেয়ে আতিশী সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘ওই নির্দেশ পেয়ে আমি কেঁদে ফেলেছি। ভাবছিলাম, কে এই মানুষ, যিনি জেলে থেকেও দিল্লিবাসীর জল ও বর্জ্য নিষ্কাশন সমস্যা নিয়ে ভেবে চলেছেন? একমাত্র অরবিন্দ কেজরিওয়ালই এমন পারেন। কারণ, তিনি নিজেকে দিল্লির ২ কোটি জনতার পরিবারের সদস্য ভাবেন।’
আপ নেতৃত্ব শুরু থেকেই বলে আসছেন, জেলে থাকলেও কেজরিওয়ালই মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন। জেলে থেকে প্রশাসন চালাবেন। কিন্তু কোনো কারণে ভবিষ্যতে যদি তা সম্ভব না হয়? সে ক্ষেত্রে কি সুনীতা হবেন দ্বিতীয় রাবড়ি দেবী? এই রাজনৈতিক জল্পনায় দিল্লি এখন বেশ সরগরম। যদিও পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়ার পর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ স্ত্রী রাবড়ি দেবীকে মুখ্যমন্ত্রী করে রাজ্যপাট সামলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে রাবড়ি দেবী কখনো হেঁশেল ছেড়ে বেরোননি।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের স্ত্রী সুনীতা অবশ্য সেই অর্থে শুধুই ‘হোমমেকার’ নন। স্বামীর মতো তিনিও ছিলেন কেন্দ্রীয় রাজস্ব দপ্তরের কর্মকর্তা। স্বামীর মতো তিনিও স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন। এর আগে ছিলেন আয়কর আপিল ট্রাইব্যুনালের কমিশনার। চাকরি ছেড়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ঢুকেছেন রাজনীতিতে। সুনীতা সেই পথে হাঁটেননি। কিন্তু এখন জোর জল্পনা চলছে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে তিনিই দায়িত্ব নিতে চলেছেন কি না। হতে চলেছেন কি না দ্বিতীয় রাবড়ি দেবী।
জল্পনাটা শুরু হয় অরবিন্দ কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর। আরও কত দিন তাঁকে জেলে থাকতে হবে জানা নেই কারও। উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া কিংবা রাজ্যসভার সদস্য সঞ্জয় সিংয়ের মতো অনির্দিষ্টকালের জন্যও হতে পারে। আপাতত তিনি কাজ চালালেও পরে পারবেন কি? সে ক্ষেত্রে কে নেবেন দিল্লির দায়িত্ব?
প্রশ্নটি উত্তরহীন। আম আদমি পার্টি (আপ) যদিও একাধিকবার বলেছে, কেজরিওয়ালই রাজ্য শাসন করবেন। দরকার হলে জেল থেকেও। ওই দৃপ্ত ঘোষণা সত্ত্বেও দলের অনেকেই মনে করছেন, সেটার লক্ষ্য ভোটের আগে দলীয় কর্মীদের মনোবল ধরে রাখা হলেও কার্যত তেমনভাবে রাজ্য চালানো সম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রীকে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সক্রিয় থাকতে হয়। কর্মকর্তাদের জন্য হাজির থাকতে হয়। নির্দেশের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। দীর্ঘকাল বন্দী থাকলে কেজরিওয়াল কেন কারও পক্ষেই তা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো সে ক্ষেত্রে কে নেবেন সেই দায়িত্ব?
এখানেই উঠে আসছে সুনীতার নাম। আসছে, কারণ, এর আগে কখনো যিনি কোনো রকম রাজনৈতিক পদক্ষেপ করেননি, পর পর দুই দিন তিনি প্রবলভাবে রাজনৈতিক বার্তা দিলেন এবং দ্বিতীয় দিন তা করলেন তাঁর স্বামী যেখান থেকে দল পরিচালনা করতেন, সেখান থেকেই।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন গত শুক্রবার সুনীতা প্রথম রাজনৈতিক কথা বলেন। তবে তা ‘এক্স’ হ্যান্ডেল মারফত। সেদিন তিনি লিখেছিলেন, ‘তিনবারের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে মোদিজি গ্রেপ্তার করালেন ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে। সবাইকে তিনি দুমড়েমুচড়ে দিতে চাইছেন। দিল্লির জনগণের সঙ্গে এটা বিশ্বাসঘাতকতা। তাঁর জীবন দেশের জন্য সমর্পিত। জনতা সব জানে। জয় হিন্দ।’
গত শনিবার তিনি যে বিবৃতিটি দেন, সেটি দলীয় দপ্তর থেকে। যেখানে বসে তাঁর স্বামী রাজনৈতিক বার্তা দিতেন, ঠিক সেখানেই বসে। বি আর আম্বেদকর ও ভগৎ সিংয়ের ছবির সামনে। দলীয় কর্তা, কর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশে বললেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, কোনো জেলই তাঁকে বেশি দিন আটকে রাখতে পারবে না।
সুনীতা শনিবার যে বার্তাটি দেন, সেটি হেফাজত থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পাঠানো। তিন মিনিটের সেই ভিডিও বার্তায় স্বামীর বয়ানে সুনীতা বলেন, দিল্লির মা–বোনেরা ভাবতে পারেন কেজরিওয়াল জেলে থাকলে মাসে মাসে তাঁদের প্রাপ্য অর্থ সাহায্যটুকু মিলবে কি না। কেজরিওয়ালের ওপর আস্থা রাখুন। কোনো জেলখানা তাঁকে অনেক দিন ধরে রাখতে পারবে না। জেল থেকে মুক্ত হয়ে সব প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন। তিন মিনিটের ওই বার্তায় কেজরিওয়াল তাঁকে জনগণের ‘ভাই ও পুত্র’ বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।
সুনীতা বলেন, কেজরিওয়াল বলেছেন, তাঁর হয়ে সবাই যেন প্রার্থনা করেন। দলের নেতা–কর্মীরা যেন জনসেবা কর্মসূচি চালিয়ে যান। বিজেপির ভাই ও কর্মীদের যেন বিদ্বেষের চোখে না দেখেন।
আপের এক সূত্র এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এ অবস্থায় জেল থেকে প্রশাসন চালানো যায় কি না, সে বিষয়ে কারও কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। কেননা স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এমন ঘটনা ঘটেনি। কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
সূত্রটি বলেন, কেজরিওয়ালকে জেলে ঢুকিয়ে বিজেপি চাইছে আমাদের দলের মনোবল ভেঙে দিতে। তারা চাইবে কিছুতেই যাতে জেল থেকে মুখ্যমন্ত্রী কাজ চালাতে না পারেন। সে জন্য তারা জবরদস্তি সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করতে পারে। সূত্র বলেন, কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শুধু। কিন্তু তিনি দোষী সাব্যস্ত হননি। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠনও করা হয়নি। দোষী প্রতিপন্ন না হলে পদ হারানোরও প্রশ্ন নেই। সবকিছুই তাই অনেক অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সেই অনুমানের একটি আগামী দিনে সুনীতাকে এগিয়ে দেওয়া কি না, সেই বিষয়ে ওই সূত্র অবশ্য কিছু বলতে চায়নি।
কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার ও তাঁকে ইডি হেফাজতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আপ ইতিমধ্যেই দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। আজ রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আগামীকাল সোম ও মঙ্গলবার দোলযাত্রা (হোলি) উপলক্ষে ছুটি। কাজেই আপের আবেদন বুধবারের আগে শোনা হবে না।
এরপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে দল। সুনীতা কেজরিওয়াল নিজে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। কাজেই তিনি দ্বিতীয় রাবড়ি দেবী হবেন কি না, সেই জল্পনা জিইয়ে থাকছে। আপাতত তিনি যে কাজ চালিয়ে যাবেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল রোববার নির্দেশ পাঠিয়ে তা বুঝিয়ে দিলেন।