রয়টার্সের বিশ্লেষণ

কানাডার অভিযোগের অনেক আগে থেকে পশ্চিমা বিশ্বে ভারতীয় গুপ্তচরদের আনাগোনা

কানাডার অটোয়ায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ হয়
রয়টার্স ফাইল ছবি

ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে আতঙ্কজনক এক শত্রুর নাম। এ দেশগুলোর অভিযোগ, ‘র’ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে। বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত অবৈধ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংস্থাটির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও করে থাকে তারা। এর মধ্যে গত মাসে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ করেন, গত জুনে ভ্যাঙ্কুভার শহরে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার ঘটনায় ভারতের সরকারি গুপ্তচরেরা জড়িত। এ অভিযোগের পর আবারও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় এসেছে ‘র’।

কানাডা সরকারের অভিযোগের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত। তাদের দাবি, কানাডা যেসব প্রমাণ থাকার কথা বলছে, তা সাজানো। তবে অটোয়া কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা মিত্রদেশগুলোকে প্রমাণগুলো দেখিয়েছে। তবে এগুলো জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হবে না।

প্রতিবেদনটি করার জন্য ভারতের ছয়জন নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। এর মধ্যে চারজন অবসরপ্রাপ্ত এবং দুজন কর্মরত। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ব্যাপারে তাঁদের প্রত্যেকেরই জানাশোনা আছে। এ কর্মকর্তারা বলেন, ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার পর ‘র’-কে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় ওই কর্মকর্তাদের সবাই তাঁদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়েছেন।

তাঁদের মধ্যে চারজন কর্মকর্তা বলেছেন, ২০০৮ সালের পর ধীরে ধীরে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোয় নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে ‘র’। বর্তমানে কর্মরত এমন এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, মুম্বাই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত এক মার্কিন নাগরিকের প্রত্যর্পণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল ভারত। আর এ ঘটনায় ‘র’ পশ্চিমা বিশ্বে নিজেদের উপস্থিতি বাড়ানোর তাগিদ বোধ করেছিল।

নরেন্দ্র মোদি ও জাস্টিন ট্রুডো

একজন সাবেক এবং একজন বর্তমান কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোয় ‘র’ তাদের গোয়েন্দা সক্ষমতার সাংকেতিক এবং কারিগরি দিকগুলোর উন্নয়ন ঘটাতে পারলেও পশ্চিমা বিশ্বে তা সম্ভব হয়নি। পশ্চিমা বিশ্বে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘র’-কে ব্যাপকভাবে মানবিক বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।

ছয়জনের মধ্যে পাঁচজন কর্মকর্তাই বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ভারতের অন্য জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার মতো ‘র’-এর অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে।

এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে নরেন্দ্র মোদির কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স। তবে তাৎক্ষণিক সাড়া পাওয়া যায়নি।

‘র’-এর প্রধান রবি সিনহার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে তাঁকে কয়েকটি বার্তা পাঠিয়েছিল রয়টার্স। তাঁর কাছ থেকেও জবাব পাওয়া যায়নি। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের মাধ্যমে মোদির কার্যালয়কে রিপোর্ট দেন সিনহা। তাঁর কাছ থেকেও প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছিল রয়টার্স। তবে তাঁর কাছ থেকেও সাড়া মেলেনি।

লক্ষ্যবস্তু করে কাউকে হত্যার ঘটনায় ‘র’-এর সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা অস্বীকার করেছেন ছয় কর্মকর্তার সবাই। তাঁদের দাবি, এ ধরনের অভিযান পরিচালনার কোনো ইচ্ছে ‘র’-এর নেই।

ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ভ্যাঙ্কুভারে শিখ নেতা নিহত হওয়ার জেরে আন্তর্জাতিকভাবে বড় ধরনের নজরদারির আওতায় আসতে পারে ‘র’।
যুক্তরাজ্যের হুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় গোয়েন্দাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ধীরাজ পরমেশা ছায়া বলেন, নিঃসন্দেহে সমসাময়িক ঘটনাগুলোর কারণে র-এর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক কৌতূহল বেড়েছে।

চীনের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা বিশ্ব দিল্লির সঙ্গে সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা বিস্তৃত করেছে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সেনসিটিভ ম্যাপিং এবং স্যাটেলাইট তথ্য আদান-প্রদানের ব্যাপারে সমঝোতা হয়।

ছয় নিরাপত্তা কর্মকর্তার একজন রয়টার্সকে বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে কানাডা যে অভিযোগ তুলেছে, তার প্রভাবে ‘র’-এর প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর আস্থা কমে যেতে পারে।

ট্রুডো ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগটি তোলার পর অটোয়া ও দিল্লির মধ্যে কূটনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। কানাডার নাগরিকদের জন্য নতুন ভিসা ইস্যু করার কাজটি স্থগিত করেছে ভারত।

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রদেশগুলোকে অনুরোধ করেছিল কানাডা। তবে তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি।

নয়াদিল্লিতে কানাডার হাইকমিশন

মুম্বাই হামলার পর বিস্তৃত হয়েছে উপস্থিতি

পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর নেতারা দীর্ঘদিন ধরেই ‘র’-কে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন। খুব সম্প্রতি পাকিস্তানে একটি মসজিদের কাছে বোমা হামলার জন্য ‘র’-কে দায়ী করেছে ইসলামাবাদ। এ অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স। তবে মন্ত্রণালয় থেকে জবাব পাওয়া যায়নি।

২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে হামলার জন্য প্রকাশ্যে পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করেছিল ভারত। দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা এ ঘটনাকে ‘র’-এর বড় ধরনের ব্যর্থতা বলে বিবেচনা করে থাকেন। মুম্বাইয়ে ওই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিদের দায়ী করেছিল দিল্লি।

ইসলামাবাদ দাবি করেছিল, এ ঘটনায় তাঁদের গুপ্তচরদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
ওই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ডেভিড হেডলির সংশ্লিষ্টতাকে কেন্দ্র করে উত্তর আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম বিস্তৃত করে ‘র’। রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেওয়া ওই ছয় কর্মকর্তার একজন বলেন, মুম্বাই হামলার জন্য স্থান নির্বাচনসহ বিভিন্ন অভিযোগে শিকাগোতে ৩৫ বছরের কারাভোগ করছেন হেডলি।

ওই কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল মুম্বাই হামলার আগে হেডলির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সতর্ক করেছিল ‘র’। বলা হয়েছিল, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে হেডলির সম্পৃক্ততা আছে। ভারতের শীর্ষ নীতিনির্ধারকেরা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, হেডলি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডাবল এজেন্ট’। তা ছাড়া হেডলিকে প্রত্যর্পণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে দিল্লির ব্যর্থতায় হতাশ হয়েছিল ‘র’।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, হেডলি ডাবল এজেন্ট ছিলেন না। দিল্লির মার্কিন দূতাবাস এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

দক্ষিণ এশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাবিষয়ক বইয়ের সহলেখক আড্রিয়ান লেভি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নিকট প্রতিবেশী দেশে পরিকল্পিত হত্যা এবং গুমের ঘটনাসহ সরাসরি কোনো পদক্ষেপে যাচ্ছে না ‘র’। তিনি আরও বলেন, ‘প্রক্সির’ সহযোগিতা নিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে সংস্থাটি। আর এ কারণে অভিযোগ উঠলে তা অস্বীকারের সুযোগ পায় ভারত।

এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে গোপনে কার্যক্রম চালানোর প্রয়োজন বোধ করে না দিল্লি। কারণ, অনেক দেশের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় প্রত্যর্পণ এবং নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগের মতো লক্ষ্যগুলো পূরণ হয়ে যায়।

লেভি মনে করেন, পশ্চিমা বিশ্বে কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে ‘র’ খুব সতর্ক। ইউরোপ থেকে অন্যান্য জায়গায় নগদ অর্থ, অস্ত্র এবং মানুষকে সরানোর ব্যবস্থা করতে পারে ‘র’। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলেই তারা মূলত সরাসরি পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।

রাজনৈতিক সমর্থন

১৯৬৮ সালে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো থেকে আলাদা হয়ে ‘র’–এর সৃষ্টি করা হয়েছিল। শুরুতে এর কাজ ছিল চীনের ওপর নজরদারি চালানো। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুরু থেকেই ইসরায়েলের মোসাদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখে ‘র’।

‘র’-এর অবসরপ্রাপ্ত একজন এবং বর্তমান দুজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ভারতে নরেন্দ্র মোদির আগের সরকারগুলো গোয়েন্দা সংস্থাটিকে খুব একটা পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি।
দক্ষিণ এশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাবিষয়ক বইয়ের সহলেখক আড্রিয়ান লেভি বলেন, মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

ভারতের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যভিত্তিক আইনসভা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান পিআরএসের তথ্য অনুযায়ী, এক সরকারি আদেশের আওতায় ‘র’-এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সংসদীয় কিংবা সাংবিধানিক অনুমোদন নেওয়ার কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না।
লেভি মনে করেন, এর মানে হলো সংস্থাটিকে খুব একটা আইনি জটিলতার মধ্যে যেতে হয়নি। এর ওপর নজরদারিও হয়েছে কম। মূলত, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে কেন্দ্রীয়ভাবেই এটি নিয়ন্ত্রিত হয়।