রাশিয়ার কাজানে চীনের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ কর্মকর্তাদের বৈঠক। ২৩ অক্টোবর
রাশিয়ার কাজানে চীনের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ কর্মকর্তাদের বৈঠক। ২৩ অক্টোবর

সি–মোদির বৈঠক কার তাগিদে, লাদাখ নিয়ে আসলেই কি চীনের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয়েছে

এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের আসরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মধ্যে বৈঠকের তাগিদেই পূর্ব লাদাখে বোঝাপড়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এসেছে অনেক প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ঠিক কী কী পরিবর্তন ঘটল? সফরের আগে কার আগ্রহেই বা এই সীমান্ত বোঝাপড়ার ঘোষণা? ভারত, নাকি চীন? উত্তরগুলো এখনো অজানা।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর শুরুর ঠিক আগে লাদাখে সমঝোতার ঘোষণা প্রথম দেয় ভারত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি পৃথকভাবে সমঝোতার কথা জানিয়ে বলেন, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) সংঘাত ও উত্তেজনা নিরসনে টহলদারির এলাকা নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। এই বোঝাপড়া ভবিষ্যতে এলএসি থেকে সেনা সরানোর কাজে সহায়ক হবে। পাশাপাশি, ২০২০ সালে সংঘর্ষের আগে সেখানকার স্থিতাবস্থায় ফেরা সম্ভবপর হবে।

ওই ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একই কথা বলেছে চীন। সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, দুই দেশ একাধিক বিতর্কিত ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সমাধানসূত্রে পৌঁছেছে, যার মধ্যে রয়েছে এলএসিতে টহলদারি ও নজরদারির বিষয়। চীনের ওই বিবৃতির পরেই বিক্রম মিশ্রি জানিয়ে দেন, কাজানে মোদি ও সির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে।

স্পষ্টতই দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করানোর তাগিদেই ওই বোঝাপড়ার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই তাগিদ কার বেশি, সেই গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের কেউই স্পষ্ট করে বলেনি, ওই সমঝোতার প্রকৃত রূপ কী। কোন কোন এলাকায় কী ধরনের সমঝোতা হয়েছে, কোন কোন এলাকায় ভারতীয় বাহিনী টহলদারি চালাতে পারবে কিংবা এর আগে যেসব জায়গা ‘বাফার জোন’ বলে চিহ্নিত হয়েছিল, তার কী হবে। এসব বিষয়ে কেউই নির্দিষ্টভাবে কিছু জানায়নি।

গতকাল বুধবার বিকেলে কাজানে মোদি–সি বৈঠকের চরিত্র ছিল পুরোপুরি দ্বিপক্ষীয় এবং কূটনৈতিক পরিভাষায় ‘স্ট্রাকচার্ড’। দুই নেতা ছাড়াও দুই দেশের প্রতিনিধিরা সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ‘গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত সমঝোতা’ সত্ত্বেও সেই বৈঠকের পর দুই দেশ কোনো যৌথ বিবৃতি দেয়নি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে দুই দেশের বোঝাপড়াকে ‘চুক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ চীনের বিবৃতিতে বোঝাপড়াকে ‘চুক্তি’ বলা হয়নি। বলা হয়েছে ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’। স্বাভাবিক কারণেই বোঝাপড়ার চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশেষ করে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের এই দ্বিপক্ষীয় বৈঠক যখন দীর্ঘ পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত হলো।

প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ‘চুক্তি’ অথবা ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ যা-ই হয়ে থাকুক, তার চরিত্র কী—সে কথা সরাসরি জানতে চেয়েছে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। কংগ্রেস মুখপাত্র ও সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে মোট ছয়টি প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর দাবি, এলএসি নিয়ে চীনের সঙ্গে যে বোঝাপড়া হয়েছে, তা দেশবাসীকে বিস্তারিত জানানো হোক।

জয়রাম জানতে চেয়েছেন, ভারতীয় বাহিনী ডেপসাংয়ের পাঁচটি টহলের পয়েন্ট পর্যন্ত টহলদারি চালাতে পারবে কি না। ২০২০ সালের আগে ওই সব পয়েন্টে ভারতীয়রা টহল দিতে পারত। একইভাবে ডেমচকের তিনটি টহল পয়েন্টে ভারতীয় জওয়ানেরা যেতে পারবে কি না। ২০২০ সালের পর থেকে ওই এলাকা ভারতের নাগালের বাইরে।

জয়রাম আরও প্রশ্ন তুলেছেন, আগে প্যাংগং হ্রদের ফিঙ্গার–৮ পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনী টহল দিতে পারত। সংঘর্ষের পর এই চার বছরে ভারতকে ফিঙ্গার–৩–এর বেশি এগোতে দেওয়া হয় না। তিনি জানতে চেয়েছেন, গোগরা উষ্ণ প্রস্রবন এলাকার তিনটি পয়েন্টে আগে ভারতীয় বাহিনী টহল দিতে যেতে পারত। সেই অধিকার এখন ভারত ফিরে পেল কি না।

কংগ্রেস নেতার আরও প্রশ্ন, স্থানীয় মেষপালকেরা বহু বছর ধরে হেলমেট টপ, মুকপা রে, রিচেন লা, টেবল টপ এবং চুশুলের গুরুং হিল এলাকার চারণভূমিতে যেতেন। তাঁরা কি ওই সব এলাকায় যেতে পারবেন? ওই সব এলাকায় ‘বাফার জোন’ তৈরি করে তা কার্যত তুলে দেওয়া হয়েছিল চীনের হাতে। এই চুক্তিতে সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটল কি না, কংগ্রেস নেতা তা–ও জানতে চেয়েছেন।

ভারত বারবার বলে এসেছে, ২০২০ সালের পূর্ববর্তী অবস্থা ফিরে না এলে, অর্থাৎ স্থিতাবস্থা বহাল না হলে সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে এগোতে পারবে না। পাঁচ বছর দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এ কারণেই বন্ধ ছিল। সেই অবস্থানের কথা দুই দেশের এই ‘চুক্তি’র পর নতুন করে জানিয়েও দিয়েছেন ভারতের সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদী।

সেনাপ্রধান গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এলএসিতে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা। সেটা হলে পরের ধাপে আসবে সেনা অপসারণ বা ‘ডিসএনগেজমেন্ট’ এবং উত্তেজনা প্রশমনের প্রশ্ন। এলএসি স্বাভাবিক হবে এভাবেই। চার বছর ধরে এটাই আমাদের অবস্থান।’

এই চুক্তির ফলে সেই কাঙ্ক্ষিত স্থিতাবস্থা ফেরত এল কি? কাজান থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে হবে।