যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগের কথা। নির্বাচন সামনে রেখে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন ক্ষমতায় গেলে বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক আরোপ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। মূল হুমকিটা ছিল চীনকে নিয়ে। ভারত থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও একই বার্তা দিয়েছিলেন তিনি।
ভারতের রপ্তানির সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের শীর্ষ দুই বাণিজ্য অংশীদারের মধ্যেও রয়েছে নয়াদিল্লি। এরই মধ্যে নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছেন ট্রাম্প। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন এবং অভিবাসনবিরোধী যেসব বক্তব্য দিয়ে এসেছেন, তাতে দুই দেশের সম্পর্ক ঘিরে নানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর বলেন, ‘ট্রাম্প যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে ভারত–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আশঙ্কার মধ্যে পড়তে পারে। তিনি যদি প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণের লক্ষ্য নিয়ে পথচলা শুরু করেন, তবে সেটি ভারতের জন্য খুবই খারাপ একটা খবর হবে।’
বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ এটা মনে করেন, ওয়াশিংটনে যে–ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত হতে থাকবে।
তবে আশার একটি আলোও দেখছেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর। সেটি হলো, ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুসম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের পথে সম্ভাব্য যে বাধা দেখা যাচ্ছে, তা হয়তো এ দুই নেতার ঘনিষ্ঠতার কারণে কিছুটা হলেও কাটানো যেতে পারে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গত বছর প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছিল। গত দশকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ (আমেরিকা প্রথমে) নীতি দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমেরিকা ফার্স্ট নীতির লক্ষ্য হলো, দেশের ভেতরে কর কমিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো। আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ালে যুক্তরাষ্ট্রে ওই পণ্যগুলোর দাম বাড়তে পারে। এতে ভারতের রপ্তানিমুখী প্রধান শিল্পগুলোর ওপর বড় ধাক্কা আসতে পারে। যেমন ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি, গাড়ি ও ওষুধ খাত।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আমেরিকা ফার্স্ট নীতি বাস্তবায়িত হলে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর চীনের জিডিপির ক্ষতি হবে শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ। বিশ্বজিৎ ধরের ভাষায়, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার। তাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় থাকবে ভারত।’
ভারত যখন নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গঠনের চেষ্টা করছে, তখন নয়াদিল্লি নতুন এক সমস্যার মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করেন ভারতের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্ব থেকে নিজেকে আরও বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে, তখন একই সময়ে বৈশ্বিকভাবে আরও অংশীদারত্ব বাড়াতে চাচ্ছে ভারত।
গত বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে বড় একটি ধাক্কা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যার চেষ্টা।
২০১৬ সাল থেকে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে এইচ–১বি ভিসাধারীরা শঙ্কার মধ্যে ছিলেন। এই ভিসার আওতায় দক্ষ বিদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রের চাকরির বাজারে যুক্ত হন। গত বছর দেশটিতে সর্বোচ্চ ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ এইচ–১বি ভিসাধারী ছিলেন ভারতীয়। আর চীনা নাগরিকদের এই ভিসা ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ।
২০১৫ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগের বছরে যুক্তরাষ্ট্রে এইচ–১বি ভিসা প্রত্যাখ্যান করার হার ছিল ৬ শতাংশ। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পর ২০১৮ সালে সেই হার বেড়ে দাঁড়ায় ২৪–এ। ২০২০ সালে তা আরও বেড়ে হয় ৩০ শতাংশ। বিশ্বজিৎ ধরের মতে, যখন রাজনৈতিক বক্তব্যে অভিবাসন–সংক্রান্ত বিষয় জোরদার হয়, তখন ভারতীয় কর্মীদের আসন্ন প্রভাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ এটা মনে করেন যে ওয়াশিংটনে যে–ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাড়তে থাকবে। নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) স্টাডিজ অ্যান্ড ফরেন পলিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষ পান্ত বলেন, গত এক দশকে ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বর্তমানে মোদি এই সম্পর্ক থেকে সুবিধা পেতে পারেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির সম্পর্ক দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সহায়তা করবে বলে মনে করেন কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রভাষক ওয়াল্টার ল্যাডইউগও। তাঁর এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে গণতান্ত্রিক সূচকে ভারতের পিছিয়ে যাওয়া এবং দেশটির সংখ্যালঘু অধিকারের মতো বিষয়গুলোর ওপর কম নজর দেওয়া হবে।
এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও চলতি বছর দুই দেশের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ—৬৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। যুদ্ধে মস্কোকে সহায়তার অভিযোগে সম্প্রতি ভারতের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর রাশিয়া নিয়ে ভারতের ওপর মার্কিন চাপ কমবে।
ট্রাম্প যদিও বারবারই রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে কথা বলেছেন। মস্কোকে সামরিকভাবে মোকাবিলার চেয়ে কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলাকে গুরুত্ব দেন তিনি। মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, বিগত বছরগুলোয় রাশিয়াসহ যেসব বিষয়ে উত্তেজনা ভারত–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে শীতল করেছিল, তা কমতে পারে।
চীনকে ঘিরেও ভারত–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ভালো হতে পারে। দুই দেশেই প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। এ ছাড়া এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দিন দিন নিজেদের উপস্থিতি জোরদার করছে বেইজিং। এমন পরিস্থিতিতে চীনকে সামলাতে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি হাত মেলাতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্কে বড় একটি ধাক্কা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যার চেষ্টা। মার্কিন কৌঁসুলিদের দাবি, ওই হত্যাচেষ্টার পেছনে হাত ছিল ভারতীয় গোয়েন্দাদের। এ ঘটনায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ভারতের একজন সাবেক গোয়েন্দাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, ট্রাম্প নিজেকে একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। রাশিয়া, চীন বা বাণিজ্যের মতো বিষয়গুলো ওয়াশিংটন–নয়াদিল্লি সম্পর্কে বাধা না হয়ে দাঁড়ালেও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে।
তবে ওআরএফের স্টাডিজ অ্যান্ড ফরেন পলিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষ পান্তের মতে, ‘ভারত যদি জো বাইডেন সরকারের আমলে এই সংকট সামাল দিতে পারে, তাহলে ট্রাম্পের আমলে তা আরও ভালোভাবে সামলাতে পারবে।’ আর কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত বলেন, ‘আজকের দিনে অধিকাংশ কূটনীতিই হয় দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির ভালো সম্পর্কের ওপর ভর করে বাধা কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত।’