ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আর জি কর মেডিকেল কলেজে নারী চিকিৎসকের নিপীড়ন ও হত্যাকে কেন্দ্র করে কলকাতায় শুরু হওয়া আন্দোলন প্রধান বিরোধী দল বিজেপির আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ফলে আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজ্যের সচিবালয় ‘নবান্ন অভিযানে’ সাধারণ ছাত্রছাত্রী, তাঁদের মা-বাবাদের বা সাধারণ মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। এদিন চোখে পড়েছে বিজেপি ও তাদের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী আর সমর্থকদের।
পুলিশ নবান্ন অভিযানে অংশ নেওয়া নেতা–কর্মীদের ওপরে কাঁদানে গ্যাসের শেল, জলকামান নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করেছে। নবান্নে পৌঁছানোর দুটি রাস্তা হাওড়া ব্রিজের কলকাতা প্রান্তে এবং কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে হাওড়ার সাঁতরাগাছি রেলওয়ে স্টেশনের কাছে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিপেটা করে। কিছু জায়গায় পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙা হলেও শেষ পর্যন্ত নবান্নে পৌঁছতে পারেননি বিক্ষোভকারীরা।
বিজেপির নেতা–কর্মীদের ওপরে পুলিশি হামলার অভিযোগে আগামীকাল বুধবার পশ্চিমবঙ্গে ১২ ঘণ্টা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে দলটি। তবে রাজ্য সরকার জানিয়েছে, এই বন্ধের বিরোধিতা করা হবে এবং রাজ্যকে সচল রাখতে পদক্ষেপ নেবে সরকার।
আজ বেশ কয়েক জায়গায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের হাতাহাতি হয়। কয়েক জায়গায় আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়েছে। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন বলে পুলিশ দাবি করেছে। বিক্ষোভকারীরাও দাবি করেছে, পুলিশের হামলায় বেশ কয়েকজন ছাত্র আহত হয়েছেন।
‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজ’ নামে একটি হঠাৎই গজিয়ে ওঠা ছাত্রসংগঠন এবং ভিন্নমত পোষণকারী রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ’ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। এসব সংগঠনের তরফে বলা হয়েছে, তাদের ওপর পুলিশ হামলা চালিয়েছে।
রাজ্য বিধানসভার বিরোধীদলীয় বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, পুলিশ সাঁতরাগাছিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর জলকামান ব্যবহার করছে, হাওড়া ব্রিজে শিক্ষার্থীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করেছে, কলেজ স্ট্রিটে লাঠিপেটা করেছে।
নব্বান্ন অভিযান আন্দোলনে বিশেষ লোকজনও জড়ো করতে পারেনি বিজেপি। পুলিশ জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত নবান্ন অভিযানে মোট বিক্ষোভকারীর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের নিচে।
৯ আগস্ট কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এক শিক্ষানবিশ নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে কার্যত রাস্তায় নেমেছিল প্রায় গোটা শহর। রাজ্যের নানা প্রান্তসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
সে সময় অনেকেই মনে করেছিলেন, এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ–আন্দোলনই রূপ নেবে, যেমনটা হয়েছিল বাংলাদেশে। এর জেরে হয়তো শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করে নির্বাচনে যেতে বাধ্য হবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের ধাঁচেই এই আন্দোলন এগোবে।
কিন্তু প্রথম দেড় সপ্তাহের পর ধীরে ধীরে আন্দোলনের রাশ চলে যায় প্রধান বিরোধী দল বিজেপির হাতে। আজ মঙ্গলবার নবান্ন ও লাল বাজার অভিযানে নেতৃত্ব দিলেন বিজেপির নেতা–কর্মীরা। আন্দোলনের মধ্যে গত সপ্তাহে সাধারণ মানুষের যে উপস্থিতি ছিল, তা আজ দেখা যায়নি।
উত্তর কলকাতার শিক্ষক অজিত মুখোপাধ্যায় গত কয়েক দিন রাস্তায় ছিলেন। আজ তিনি কেন নামলেন না—এমন প্রশ্নে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া যেকোনো আন্দোলনে কোনো একটা পর্যায়ে রাজনৈতিক দল অবশ্যই ঢুকে পড়ে। কারণ, সাধারণ মানুষের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন বা সরকার চালানো সম্ভব নয়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো, ঠিক কোন সময় গণ-আন্দোলনে একটা রাজনৈতিক দল ঢুকবে এবং সেটিকে তাদের আন্দোলন বলে দাবি করবে। যদি তারা সেটা ঠিক সময় করতে পারে, তাহলে তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এখানে এই মুহূর্তে এই আন্দোলনে বিজেপির ঢোকা উচিত হয়নি, যার কারণে আমার মতো মানুষেরা শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন থেকে কিছুটা হলেও সরে গেছেন।’
আর জি কর হাসপাতালের ঘটনার বিচারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা চিকিৎসকদের স্বীকৃত সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ জুনিয়র ডাক্তার অ্যাসোসিয়েশন’ আজ এক সংবাদ সম্মেলন করেছে। এতে তারা জানিয়েছে, মঙ্গলবার ‘নবান্ন অভিযানে’ তাদের কোনো অংশ ছিল না। তারা প্রতিবাদ চালিয়ে যাবে এবং প্রয়োজনে ভবিষ্যতে আরও জোরদার করবে। আগামীকাল একটি রাজনৈতিক সংগঠন (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গ ধর্মঘটের যে ডাক দিয়েছে, তাতেও তারা থাকবে না।
শিক্ষক অজিত মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, এমন চললে ভবিষ্যতে আবার এই আন্দোলনের রাশ সাধারণ মানুষের হাতে ফিরে আসবে কি না বা তাঁর মতো সাধারণ মানুষ নিপীড়িত চিকিৎসকের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসবেন কি না, সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন।