পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বঞ্চনার কথা জানাতে গেলে মমতার মাইক বন্ধ, বর্জন করলেন নীতি আয়োগের বৈঠক

ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে বঞ্চনার প্রতিবাদে সব বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী নীতি আয়োগের (আগের নাম যোজনা কমিশন) বৈঠক বর্জন করলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু সেই বৈঠক থেকে মাঝপথে তিনিও বেরিয়ে এলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে।

আজ শনিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ডাকা সেই বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, সরকারপক্ষের মুখ্যমন্ত্রীদের ১০ থেকে ২০ মিনিট বলতে দেওয়া হলেও তাঁকে বরাদ্দ করা হয় মাত্র ৫ মিনিট। তা-ও মাঝপথে মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। একজন মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে এটা অপমানজনক।

এই বৈঠক বর্জন করেছিলেন তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক ও হিমাচল প্রদেশের তিন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী যথাক্রমে রেবন্ত রেড্ডি, সিদ্দারামাইয়া ও সুখবিন্দর সিং সুখু। গরহাজির ছিলেন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক মুখ্যমন্ত্রীরাও। যেমন তামিলনাড়ুর ডিএমকে মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন, ঝাড়খন্ডের জেএমএম মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন, পাঞ্জাবের আম আদমি পার্টির মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত সিং মান ও কেরালার সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল কারাগারে। তাঁর যোগ দেওয়ার প্রশ্ন ছিল না।

একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁর অভিযোগ, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সবার সঙ্গে আলোচনা না করে কংগ্রেস এককভাবে এই বৈঠক বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ততক্ষণে তিনি বৈঠকে হাজির থাকবেন বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাই যাবেন।

মমতা অবশ্য জানিয়েছিলেন, বৈঠকে তিনি বিরোধীদের প্রতিনিধিত্ব করে জানাবেন, কীভাবে বিরোধী রাজ্যগুলোকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বঞ্চিত করছে। কিন্তু সে কথাও তাঁকে বলতে দেওয়া হলো না। মাঝপথে মাইক বন্ধ করে দেওয়া হলো।

মমতা আগেই বলেছিলেন, নীতি আয়োগ বন্ধ করে পুরোনো যোজনা কমিশন ফেরত আনা উচিত। আজ বৈঠক থেকে বেরিয়ে মমতা বলেন, আর কোনো দিন তিনি নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দেবেন না।

বিরোধীদের মাইক বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি ওঠে লোকসভার অধিবেশনে। বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী একাধিকবার এই অভিযোগ করেছেন। এবার সেই একই অভিযোগ শোনা গেল মমতার কণ্ঠে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বৈঠকে মাইক বন্ধ করার আগে বলেছি, কীভাবে বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলোকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ন্যায্য দাবি মানা হচ্ছে না। অথচ প্রতিটি রাজ্যের ও আঞ্চলিক দলের নানা আকাঙ্ক্ষা থাকে। রাজ্য শক্তিশালী হলেই দেশ শক্তিশালী হয়।’

বৈঠকে মমতা বলেন, ‘বিরোধীদের পক্ষে একমাত্র আমিই এখানে উপস্থিত আছি। এসেছি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মজবুত করার কথা বলতে। অথচ বাজেটে বিরোধী রাজ্যগুলোকে চরম বঞ্চনা করা হলো।’

মমতার এই আচরণ রাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যত্রও বিরোধী মহলের একাংশ মনে করে, মমতার সঙ্গে বিজেপির একটা অঘোষিত অলিখিত আঁতাত আছে। বিজেপি চায়, মমতা বিরোধী রাজনীতি করলেও তিনি যেন কখনো কংগ্রেসকে বিরোধী ঐক্যের অনুঘটক হতে না দেন।

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর প্রতি মমতার রাজনৈতিক অনীহাও সর্বজনবিদিত। রাহুলের নেতৃত্ব তিনি কখনো মেনে নেননি। নিতে চানও না। সেই কারণে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক হয়েও তিনি আলগা আলগা থাকতে পছন্দ করেন। কেজরিওয়াল, অখিলেশ, উদ্ধব ঠাকরে, শারদ পাওয়ারদের সঙ্গে পৃথক রাজনৈতিক সমীকরণ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

মমতার এই রাজনীতি আবার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও পছন্দের। কারণ, তা লাভজনক। এর ফলে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের অনৈক্য প্রকাশ পায়। জনতার মধ্যে অন্য বার্তা বয়ে আনে। এই সম্পর্ক মমতার পক্ষেও লাভজনক বলে রাজ্যের বিরোধীদের বিশ্বাস। তাঁরা মনে করেন, এই আচরণ তাঁর পরিবারকে ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগের নজর থেকে দূরে রাখে।

মমতার অভিযোগ অবশ্য নস্যাৎ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি) আজ শনিবার ‘এক্স’ মারফত জানায়, নীতি আয়োগের নবম গভর্নিং কাউন্সিলের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাইক বন্ধ করা হয়নি। ঘড়িতে শুধু দেখানো হয়েছিল, তাঁর বলার সময় শেষ হয়ে গেছে। কথাটি ঘন্টি বাজিয়ে তাঁকে জানানো হয়নি।

মমতার অভিযোগ, তাঁকে মাত্র পাঁচ মিনিট বলতে দেওয়া হলেও অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুকে ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। আসাম, গোয়া, ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রীরা বলেছেন ১০ থেকে ১২ মিনিট।

বৈঠকের শেষ পর্যন্ত মমতা যে থাকবেন না, সেই ইঙ্গিত তিনি অবশ্য আগেই দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, বৈঠকে যাবেন। বলতে দিলে বলবেন। না হলে প্রতিবাদ করবেন। মমতার অনুরোধ মেনে বৈঠকে অবশ্য তাঁকে আগেই বলতে দেওয়া হয়েছিল। কারণ, আজ শনিবারেই তাঁর কলকাতা ফিরে যাওয়ার কথা। ইংরেজি বর্ণমালা অনুযায়ী ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ (ডব্লিউ) সুযোগ পায় শেষ দিকে। রাজ্যের নাম বদলে ‘বাংলা’ রাখার সুপারিশ তিনি সেই কারণেই করেছিলেন, যাতে ইংরেজি বর্ণমালা অনুযায়ী ‘বি’ বাংলা সুযোগ পায় শুরুতেই।

এনডিএ জোটের শরিক হলেও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার আজ শনিবার নীতি আয়োগের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না।