ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ছাড়াই গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন ও তিস্তা নিয়ে আলোচনা করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। গতকাল সোমবার কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি ভাগাভাগির চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
এখানেই থেমে থাকেননি মমতা। তিনি গতকাল এই দুই নদীর বিষয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থান জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আশঙ্কার কারণ নির্দিষ্টভাবে চিঠিতে লিখেছেন। প্রথমত গঙ্গা ক্রমেই আরও পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে বলে দাবি করে মমতা বলেন, এর ফলে ২০০ বছর ধরে (গঙ্গার সঙ্গে, যা বাংলাদেশে পদ্মা) অন্য অনেক নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া নদীর মধ্যে রয়েছে জলঙ্গি ও মাথাভাঙ্গা। ফলে সুন্দরবনে জল কম যাচ্ছে।
এই পুরো বিষয়ের জন্য নির্দিষ্টভাবে ১৯৭৫ সালে চালু হওয়া ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বাঁধের কাজ ছিল মৃতপ্রায় হুগলি নদীতে পলি মাটি কমিয়ে সেটাকে বাঁচিয়ে তোলা। হুগলি নদীকে বাঁচানোর এই কাজ করতে গিয়ে বিপদ বেড়েছে। মমতা চিঠিতে লিখেছেন, ‘হুগলিতে পলি কম পড়ার ফলে সুন্দরবন অববাহিকার বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে টান পড়েছে। এতে আরও বড় বিপদ হয়েছে।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, এই বাঁধের ফলে উজান ও ভাটিতে প্রবল ভাঙন শুরু হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর। ধ্বংস হয়েছে প্রচুর সম্পত্তি, যার মধ্যে রয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যুতের মতো স্থাপনা–অবকাঠামো। এই ভাঙন রোধে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গকে যে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা–ও দেয়নি।
মমতা চিঠিতে লিখেন, তা ছাড়া ২০০৫ সালে নদীর প্রবাহের দিকে ১২০ কিলোমিটার এবং ওপরের দিকে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধ কর্তৃপক্ষের কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল ভাঙন রোধ, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এই বিষয়ে ২০১৭ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে তিনটি চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তিস্তা প্রসঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গের প্রধান আপত্তির কারণ নির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, সিকিমে একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার পানি কমে গেছে। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে পানি ভাগ করা হলে উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে মমতা বলেন, উত্তরবঙ্গে জেতার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার এই কাজগুলো করছে। কিন্তু মনে রাখছে না, রাজ্যে এর কী প্রভাব পড়বে। সিকিমে পরিস্থিতির পরিবর্তন না করে তিস্তার পানির পরিমাণ পশ্চিমবঙ্গে বাড়ানো সম্ভব নয়।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও ধারাবাহিকভাবে প্রায় ১০ বছর ধরে ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করছেন। বিশেষত ২০১৬ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার বিহারে বড় বন্যা হলে সোচ্চার হন তিনি। নীতীশ কুমারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়ে বিহারের পরিবেশবাদী আইনজীবী গোপাল কৃষ্ণ প্রথম আলোকে বলেন, নীতীশের বক্তব্যের ভিত্তি, পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্যের বক্তব্য।
কপিল ১৯৬১ সালে বলেছিলেন, ফারাক্কার কারণে বিপদে পড়বে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব ভারত।
গঙ্গা থেকে বেরোনো বিহারের কোসি নদী নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন গোপাল কৃষ্ণ। তিনি বলছিলেন, ‘পূর্ব উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলা থেকে উত্তর, পূর্ব ও মধ্য বিহারের অন্তত সাতটি জেলা ফারাক্কার এই বাঁধ ও অন্য বাঁধের কারণে বিপর্যস্ত। প্রতিবছরই হয় বন্যা হচ্ছে অথবা আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
গোপাল কৃষ্ণ বলেন, ‘এই বন্যা যে শুধু বৃষ্টির কারণে হচ্ছে, সেটা বলা যাবে না। কারণ, ২০২১ সালে আমরা দেখেছি বৃষ্টির কারণে জুনে বন্যা হয়েছে। তারপর আগস্টে আবার বন্যা হয়েছে, যার কারণ ফারাক্কার মতো বাঁধ। রাজধানী পাটনাসহ বিভিন্ন জেলায় জল এতটাই উঠে যাচ্ছে, যা অতীতে ওঠেনি। এটাই মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ বারবার বলছেন।’
গোপাল কৃষ্ণ আরও বলেন, ‘এ কারণে নীতীশ কুমার এখন বাঁধটি “ডিকমিশন” করার বা ভেঙে ফেলার দাবি তুলেছেন। এটা এমন কিছু অবাস্তব ঘটনা নয় এবং আমরা অন্য দেশে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র দেখেছি যে বাঁধ “ডিকমিশন” করা হচ্ছে। পরিবেশ, ভূগোল ও সার্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে এটা করা প্রয়োজন। কারণ, সবকিছুরই একটা আয়ু আছে।’
গোপাল কৃষ্ণ বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো বিহারের মুখ্যমন্ত্রীও মনে করেন, পলি তোলার কাজ এবং প্রবাহ একই সূত্রে গাঁথা। একটির সমাধান না করে অন্যটি বজায় রাখা মুশকিল।
বস্তুত এসব কথাই ১৯৬০ সালে ও পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন কপিল ভট্টাচার্য। কিন্তু সেই সময়ে তাঁকে ‘দেশদ্রোহী ও পাকিস্তানের চর’ বলে আখ্যা দিয়েছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখন তার মাশুল বিহার ও পশ্চিমবঙ্গকে তো দিতে হচ্ছেই, একই সঙ্গে বিপদ বাড়ছে বাংলাদেশেও।