ভারতে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ চলছে। এই প্রচণ্ড গরমে দেশজুড়ে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। এতে মৃত্যুও হচ্ছে। দেশটির রাজধানী দিল্লির বড় হাসপাতালগুলোর একটি রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালের (আরএমএলএইচ) চিকিৎসক অজয় চৌহান বলেছেন, এর আগে তিনি এমন পরিস্থিতি আর দেখেননি।
অজয় চৌহান বলেন, ‘নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ চলছে। এখানে আমি ১৩ বছর ধরে কাজ করছি। এই সময়কালে হিটস্ট্রোকে কারও মৃত্যু হয়েছে, এমন কারও মৃত্যুসনদে আমি স্বাক্ষর করেছি, তা মনে করতে পারি না। অথচ এই বছর এমন বেশ কয়েকটি মৃত্যুসনদে আমাকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে।’
অনেক দিন থেকেই দিল্লিতে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ চলছে। গত মে মাস থেকে প্রতিদিনের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে তা এখন প্রায় ৫০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। আর্দ্রতা ও গরম বাতাস এই তাপকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। পানিসংকট ও ক্রমবর্ধমান চাহিদায় বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে এই সমস্যা আরও বেড়ে যাচ্ছে। গরমে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে অসুস্থ হয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ১১০ জনের বেশি মারা গেছেন।
প্রচণ্ড তাপজনিত গুরুতর অসুস্থতা হলো হিটস্ট্রোক। তিনটি প্রধান লক্ষণের মাধ্যমে এটি চিহ্নিত করা হয়—উচ্চ তাপ ও আর্দ্রতার সংস্পর্শে আসা; শরীরের তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বা তার বেশি হওয়া এবং মানসিক পরিবর্তন যেমন হালকা বিভ্রান্তি বা চেতনা হারানো। হিটস্ট্রোক একটি নীরব ঘাতক। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সূর্যের সংস্পর্শে আসার কয়েক ঘণ্টা পরে অসুস্থ হতে শুরু করেন। ভারতের জাতীয় রোগনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিটস্ট্রোককে ‘জীবনের জন্য হুমকি’ বলে ঘোষণা করেছে। এতে মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৬৪ শতাংশ।
দিল্লিতে অজয় চৌহানের আরএমএলএইচ হাসপাতালে গত মে মাসের শেষের দিকে প্রথমবারের মতো একটি হিটস্ট্রোক ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। এই ক্লিনিকে হিটস্ট্রোকে এখন পর্যন্ত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। আরও অন্তত ৪০ জনের চিকিত্সা দেওয়া হয়েছে।
তাঁদের অধিকাংশই পুরুষ। প্রচণ্ড গরমে তাঁদের কেউ বাইরে কাজ করেন; কেউবা ছোট, অনিয়ন্ত্রিত কারখানায় কাজ করেন। এই তাপপ্রবাহ শুধু দিল্লিতে নয়, ভারতের বিভিন্ন স্থানে চলছে। গত মার্চ থেকে গরমজনিত অসুস্থতায় ১১০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে মাত্র তিন দিনেই উত্তর প্রদেশ ও ওডিশা রাজ্যে ৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
আরএমএলএইচ ক্লিনিকে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের বাঁচানোর জন্য দ্রুত জলবায়ু ও জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
কয়েক দিন আগে এক ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৭ দশমিক ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেড়ে গিয়েছিল। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই ব্যক্তি হিটস্ট্রোকে ভুগছিলেন।
এমন তাপমাত্রায় মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ঠিকঠাক কাজ করে না, কোষগুলো ক্ষয় হয়ে একপর্যায়ে হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বিকল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ত্বকে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শরীরে ঘাম হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
আরএমএলএইচ হাসপাতালের জরুরি হিটস্ট্রোক ক্লিনিকে দুটি বড় সিরামিক টাব, একটি ২০০ কেজি বরফ তৈরির মেশিন, রেকটাল থার্মোমিটার ও বরফের বাক্স রাখা হয়েছে। এখানে চিকিৎসকেরা রোগীকে ২৫০ লিটার সিরামিক টাবের বরফের পানিতে চুবিয়ে রাখেন। এই টাবের তাপমাত্রা শূন্য থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রাখা। এভাবে রোগীকে ২৫ মিনিট রাখার পর পরবর্তী চিকিত্সার জন্য ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়।
চিকিৎসক অজয় চৌহান বলেন, ‘প্রাথমিক শীতলতা রোগীর জীবন বাঁচায়। এখানে প্রতিটি সেকেন্ড গণনা করা হয়। একটু দেরি হলেই বিপদ ঘটতে পারে। রোগীর রক্তপাত হতে পারে অথবা কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
এমনিতে দিল্লির পরিবেশ–পরিস্থিতিতে কারও অসুস্থ হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে জীবনযাপন অনেক কঠিন। বাসিন্দাদের এক–তৃতীয়াংশ নিম্নমানের ও ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করে। শহরের ৬ হাজার ৪০০টি পুরোনো বস্তিতে ১০ লাখের বেশি পরিবারের বসবাস। এখানে পর্যাপ্ত আলো–বাতাসের অভাবসহ মৌসুমি জীবিকা সংকট লেগেই আছে। এখানকার পুরুষেরা বাইরে কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন; ঐতিহ্যবাহী পুরোনো চুলাসহ রান্নাঘরে দীর্ঘ সময় কাটানোর কারণে নারীরাও নিয়মিত অসুস্থ হয়ে থাকেন।
দিল্লিতে সবুজ পরিবেশ এখন প্রায় নেই বললেই চলে। গ্রীষ্ম মৌসুমে এই শহর একটি জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত হয়।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আরএমএলএইচে একজন দিনমজুর ভর্তি হয়েছেন। ওই দিনমজুরের স্ত্রী অঞ্জনা কুমারী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বস্তিতে তাঁদের ঝুপড়ির একমাত্র ফ্যানটি আর কোনো কাজ করছে না। তাঁর স্বামী গত সোমবার সারা দিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমাতে পারেননি। পরে তাঁর খিঁচুনি, বমি ও ডায়রিয়া শুরু হয়। ওই রাতেই তিনি স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
অঞ্জনা কুমারী বলেন, ‘ডাক্তার আমাকে বলেছেন, তিনি (স্বামী) কিছু সময়ের জন্য হাঁটতে পারবেন না। তাঁর অনেক যত্ন–আত্তির প্রয়োজন।’
এই তাপপ্রবাহে যাঁরা বাইরে কাজ করেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন। দিল্লির রাস্তায় যাঁরা হকারের কাজ করেন, তাঁদের তাপ কীভাবে প্রভাবিত করে, সে বিষয়ে একটি নতুন গ্রিনপিস সমীক্ষা হয়েছে। এই সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের একটি বড় সংখ্যা গরম আবহাওয়ার কারণে স্বাস্থ্য সমস্যার কথা জানিয়েছেন। ৭৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা যেমন বিরক্তি, মাথাব্যথা, ডিহাইড্রেশন, রোদে পোড়া, ক্লান্তি ও পেশিতে টান ধরার কথা বলেছেন। তাঁদের অধিকাংশই অর্থের অভাবে চিকিৎসাসেবা পেতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন।
দিল্লির রাস্তায় হাতে চাকা ঘুরিয়ে আখের রস বিক্রি করেন গুড্ডি। এই নারী গ্রিনপিসকে বলেন, ‘গরম প্রতিদিন বাড়ছে। আমরা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি। আমি আর কি সম্পদ সংগ্রহ করতে পারি? যদি সম্ভব হয়, আশপাশে কিছু গাছ এবং গাছপালা থাকা উচিত। যেন তাজা বাতাস বইতে থাকে। এতে শরীর কিছুটা স্বস্তি পায়।’
গুড্ডি আরও বলেন, ‘সারা দিন সূর্যের তাপে সেদ্ধ হওয়ার পর রাতে আর খাবার খেতে ভালো লাগে না। এত ক্লান্তি আসে যে ইচ্ছা করে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ি।’
পুরো ভারতে গরমে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সেন্টার ফর র্যাপিড ইনসাইটসের (সিআরআই) দেশব্যাপী করা নতুন এক সমীক্ষা তাপপ্রবাহ কীভাবে মানুষকে ক্ষতি করে এবং উৎপাদনশীলতা নষ্ট করে দেয়, সে সম্পর্কে কিছু বিষয় উল্লেখ করেছে।
এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, অংশ নেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে ৪৫ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য গত মাসে গরম থেকে অসুস্থ হয়েছেন। ৬৭ শতাংশের বেশি পরিবারের সদস্য পাঁচ দিনের বেশি অসুস্থ ছিলেন। এই প্রভাব দরিদ্রদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। বিশেষ করে যেসব পরিবারে অন্তত একটি মোটরসাইকেল আছে, এমন ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং কোনো যানবাহন নেই, এমন ২৮ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারের সদস্যরা পাঁচ দিনের বেশি অসুস্থ ছিলেন। আর গাড়ি আছে, এমন পরিবারের জন্য এই চিত্রটি ২১ দশমিক ৮ শতাংশের কম ছিল।
২০২১ সালের ল্যানসেটের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, অত্যধিক তাপের কারণে ভারতে ১৬৭ দশমিক ২ বিলিয়ন সম্ভাব্য শ্রমঘণ্টার ক্ষতি হয়। সিআরআইয়ের পরিচালক নীলাঞ্জন সরকার বলেছেন, ‘উৎপাদনশীলতার ক্ষতি বিস্ময়কর।’
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তাপপ্রবাহে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু ভারত মৃত্যুর তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে না, তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে।
বর্তমানে দিল্লিতে তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি ভয়াবহ। ২০২২ সালে ভারত ২০৩টি তাপপ্রবাহের দিন দেখেছিল, যা রেকর্ডে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে দিল্লির ওপর দিয়ে প্রায় ১৭টি তাপপ্রবাহ গেছে। গত মার্চ মাসকে ভারতের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস হিসেবে রেকর্ড করেছে আবহাওয়া বিভাগ। আর দিল্লিতে ৭২ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় উষ্ণতম মাস ছিল গত এপ্রিল।
অজয় চৌহান বলেন, ‘এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে। আমাদের খুব সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।’