রানি লাখো ভারতীয়র মন জয় করেছিলেন যেভাবে

নয়া দিল্লির প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেসে ১৯৯৭ সালের ১৩ অক্টোবর বক্তব্য দেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
ছবি : রয়টার্স

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রথমবার ভারত সফরে এসেছিলেন ১৯৬১ সালের জানুয়ারিতে। ওই সময় দিল্লির বিমানবন্দর থেকে রানির থাকার নির্ধারিত স্থান ভারতীয় রাষ্ট্রপতির বাসভবন লোকে লোকারণ্য ছিল। রানিকে একঝলক দেখতে ১০ লাখের বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিল দিল্লিতে। নিউইয়র্ক টাইমস ওই সময় প্রতিবেদনে লিখেছিল, এ সপ্তাহে ভারতীয়রা তাদের সব সমস্যার কথা ভুলে গেছে। অর্থনৈতিক দুর্দশা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং কমিউনিস্ট চীন সম্পর্কে সব উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলেছে তারা। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এখানে এসেছেন। আর তা নিয়েই রাজধানী বেশি ব্যস্ত। ট্রেনে, বাসে, গরুর গাড়িতে করে রাজধানীতে মানুষ এসেছে। রাজদম্পতিকে একঝলক দেখার আশায় তারা রাস্তা, লনসহ সব জায়গাজুড়ে অবস্থান নিয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই সময় রানি কোনো শাসক হিসেবে তাঁর রাজ্য সফরে আসেননি। বরং তিনি এসেছিলেন আরেকটি স্বাধীন দেশে। ১৯৪৭ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে ভারত। দেশটির স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ সিংহাসনে বসেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ওই সফর ভারতকেও একজন ব্রিটিশ শাসককে দেখানোর সুযোগ করে দেয় যে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর দেশটি ভালো কিছু করতে পেরেছে। দেশটির বিমানবন্দর, নতুন নতুন বাড়ি, অফিস ভবন, স্টিল কারখানা ও পারমাণবিক চুল্লির মতো বিষয়গুলো রানির সামনে তুলে ধরার সুযোগ পায় ভারত।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও তাঁর স্বামী ডিউক অব এডিনবরা প্রিন্স ফিলিপ ছয় সপ্তাহের জন্য ভারতবর্ষ সফর করেন। তাঁরা এ সময় মুম্বাই, চেন্নাই ও কলকাতার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান দর্শন করেন। তাঁরা আগ্রার তাজমহল, জয়পুরের পিংক প্যালেস ও বরানসি যান। এ সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে তাঁরা অতিথি ছিলেন। দিল্লির রামলীলা ময়দানে ভাষণ দেন।

কলকাতায় মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্মরণে তৈরি স্মৃতিস্তম্ভে যান তিনি। তাঁর সম্মানে সেখানে ঘোড়দৌড় আয়োজন করা হয়। বিমানবন্দর থেকে কলকাতায় খোলা গাড়িতে রানির ঘুরে বেড়ানো নিয়ে ইয়র্কশায়ার পোস্ট–এর একটি সম্পাদকীয় ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম অল ইন্ডিয়া রেডিওতে এক সাংবাদিক তুলে ধরেন। তাতে বলা হয়, তিনি হয়তো ভারতের সম্রাজ্ঞী নন, কিন্তু ভারতীয় জনতার উচ্ছ্বাস প্রমাণ করেছে তিনি তখনো কোটি কোটি ভারতীয় হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী ছিলেন।

এরপর ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সফর করেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এবার তাঁর সফর ছিল কমনওয়েলথ নেতাদের এক সম্মেলনে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে। রানির স্মরণীয় আরেকটি ভারত সফরের ঘটনা ছিল ১৯৯৭ সালে। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি ভারতে আসেন। এর আগের বছরই রানির পুত্রবধূ প্রিন্সেস ডায়ানা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর শেষকৃত্যের পর এটাই ছিল রানির জনসমক্ষে বড় কোনো অনুষ্ঠানে আসার ঘটনা। তবে রানির এবারের সফরে বেশ কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মহল থেকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানের মধ্যে তিনি জালিয়ানওয়ালা বাগ যেতে চেয়েছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে কয়েক শ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু ওই সফরের আগে তিনি দিল্লিতে এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘অতীতে জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো কিছু কঠিন অধ্যায় আমাদের পার হতে হয়েছে, যা গোপন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু ইতিহাস পুনরায় লেখা যায় না। তবে কখনো কখনো আমরা অন্য ইচ্ছা পোষণ করতে পারি। এটার যেমন দুঃখের মুহূর্ত আছে, তেমনি আছে আনন্দেরও। আমাদের অবশ্যই দুঃখ থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং আনন্দকে গড়ে তুলতে হবে।’

রানির এ বক্তব্য সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারা ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাজ্যকে ক্ষমা চাইতে বলেছিল। তবে বিক্ষোভের পরিবর্তে বিমানবন্দর থেকে অমৃতসর শহর পর্যন্ত ১০ মাইল পথ পতাকা নেড়ে লোকজন রানিকে অভ্যর্থনা জানায়। রানির পোশাক নিয়েও ভারতে প্রচুর উন্মাদনা লক্ষ করা যায়। ভারতের ইন্ডিয়া টুডে ১৯৮৩ সালে রানির ভারত সফরের সময় রানির পোশাক নিয়ে তুমুল উন্মাদনার কথা প্রকাশ করে।

রানি তাঁর তিনবারের ভারত সফরের স্মৃতিগুলো লালন করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতীয় জনগণের উষ্ণতা, আতিথেয়তা এবং ভারতের ঐশ্বর্য ও বৈচিত্র্য আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।’