কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ নারী চিকিৎসক ধর্ষণ-হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে ‘নজিরবিহীন’ একটি দিন দেখল পশ্চিমবঙ্গবাসী।
বিচারসহ অন্যান্য দাবিতে আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকেরা রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নের মুখ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার ফিরে আসেন।
জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য নবান্নের ভেতরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসকেরা তাঁদের শর্তে অনড়। তাঁরা নবান্নের বাইর দাঁড়িয়ে থাকেন প্রায় দুই ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি আর হয়নি। জুনিয়র চিকিৎসকেরা নবান্নের সামনে থেকে ফিরে আসেন। মমতার শাসনামলে এই প্রথম এমন একটি ঘটনা দেখল পশ্চিমবঙ্গবাসী।
পরে সাংবাদিকদের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য তিনি দুই ঘণ্টার বেশি সময় বসেছিলেন। কিন্তু বৈঠকটি হয়নি। তিনি পদত্যাগ করতে রাজি আছেন। কিন্তু কেউ কেউ বিচার চান না। চান ক্ষমতার চেয়ার। আন্দোলনে রাজনৈতিক চক্রান্ত চলছে।
মমতা আরও বলেন, ‘আমার পদত্যাগে যদি সব ঠিক হয়ে যায়, তাহলে আমার পদত্যাগ করতে সমস্যা নেই।’
তবে কি সত্যি সত্যি মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন? এখন এই প্রশ্ন রাজ্যবাসীর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
কিন্তু গতকাল কেনো জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকটি হলো না? এর কারণ মূলত—বৈঠকের সরাসরি (লাইভ) সম্প্রচার নিয়ে মতভেদ।
জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যে বৈঠকটি হবে, তা লাইভ সম্প্রচার করতে হবে। কিন্তু এই দাবি মানেননি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মত, বৈঠক করতে তিনি রাজি। কিন্তু লাইভ করতে রাজি নন। এখানেই সমস্যা বাধে।
গত ৯ আগস্ট কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষানবিশ নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতে বিক্ষোভ শুরু হয়। ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকেরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্দোলনের ফলে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
৫ দফা দাবিতে গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে রাজ্যের স্বাস্থ্য ভবনের বাইরে অবস্থান করছেন ২৬টি মেডিকেল কলেজের শত শত জুনিয়র চিকিৎসক। তাঁদের দাবি, সুপ্রিম কোর্ট যতই কাজে ফিরতে বলুন, যতক্ষণ না তাঁরা নিরাপত্তা পাচ্ছেন, ততক্ষণ তাঁরা কাজে যোগ দেবেন না।
গত সোমবার যখন সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি ওঠে, তখন রাজ্য সরকারের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, চিকিৎসকদের গত এক মাসের আন্দোলনের কারণে রাজ্যে ২৩ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। দেশের শীর্ষ আদালত অপর পক্ষের বক্তব্য না শুনে নির্দেশ দেন, মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে সবাইকে কাজে ফিরতে হবে। এরপরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন রাজ্যের চিকিৎসকেরা। জুনিয়র চিকিৎসকেরা পাঁচ দফা দাবি নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান নেন। তাঁদের পাশে রয়েছেন সিনিয়র চিকিৎসকেরা।
সিনিয়র চিকিৎসকেরা বলছেন, যতক্ষণ না জুনিয়রদের কথা মেনে নেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ তাঁরা এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে যাবেন। যদি রাজ্য সরকার কোনো কঠিন পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের সব সরকারি হাসপাতালের আউটডোর বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। শুধু খোলা থাকবে জরুরি বিভাগ।
গতকাল নবান্ন থেকে আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে ই–মেইল আসে। চিকিৎসকেরা ফিরতি ই–মেইলে জানান, তাঁরা বৈঠকে যোগ দেবেন। ২৬টি মেডিকেল কলেজের ৩০ জন জুনিয়র চিকিৎসক প্রতিনিধি থাকবেন বৈঠকে। পুরো বৈঠক লাইভ করতে হবে, যাতে রাজ্যের মানুষ জানতে পারে, ভেতরে কী কথা হচ্ছে।
কিন্তু নবান্নের তরফে বলা হয়, ১৫ জন প্রতিনিধি বৈঠকে আসতে পারবে। বৈঠকে কোনো লাইভ হবে না।
এরপর চিকিৎসকেরা জানান, তাঁরা স্বচ্ছতার সঙ্গে বৈঠক করতে চান। আর এই লাইভের বিষয়ের পথ তো দেখিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে। মুখ্যমন্ত্রী যদি প্রশাসনিক বৈঠক লাইভ করতে পারেন, প্রকাশ্যে মন্ত্রী-আমলাদের বকাঝকা করতে পারেন, হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের শুনানি যদি লাইভ হতে পারে, সেখানে কেন মমতার সঙ্গে বৈঠক লাইভ করা যাবে না? তাঁরা মনে করেন, এই লাইভ হলো স্বচ্ছতার পথ।
প্রশাসন ৩০ জন প্রতিনিধির বিষয়ে মত দিলেও বৈঠক লাইভ হবে কি না, তা দ্বিতীয়বার আর জানায়নি। পরে প্রশাসনের তরফ থেকে গাড়ি পাঠানো হয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা সেই গাড়ি গ্রহণ করেননি। বরং তাঁরা নিজেরাই একটি বাসে করে নবান্নের সামনে যান।
একপর্যায়ে প্রশাসন জানায়, বৈঠক লাইভ করার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অনুমতি নেই। এতে বেঁকে বসেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। তাঁরা নবান্নের বাইরে ঠায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন।
নবান্নের ভেতরে মুখ্যমন্ত্রী, বাইরে চিকিৎসকেরা। ছোটাছুটি শুরু করে দেন মুখ্যসচিব থেকে প্রশাসনের কর্তারা। তাঁর একবার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যান, আবার চিকিৎসকদের বোঝাতে আসেন। কিন্তু শেষমেশ বৈঠক না করেই ফিরে যান চিকিৎসকেরা।
পরে মুখ্যমন্ত্রী একা লাইভে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কিছু বিষয় চাইলেও লাইভ করা সম্ভব নয়, তা চিকিৎসকদের বোঝানো যাবে না।
ধারণা করা হচ্ছিল, এই বৈঠকটি হলে অনেকটাই শান্তি ফিরে আসবে রাজ্যে। শর্তের টানাপোড়েনে ভেস্তে যায় বৈঠক।
সিনিয়র চিকিৎসকের বলেছেন, বৈঠকের লাইভ হলে তদন্তের অনেক ফাঁকফোকর বের হয়ে পড়ত। আর সে কারণেই লাইভে রাজি হননি মুখ্যমন্ত্রী।