ভারতের লোকসভার সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) আসাদউদ্দিন ওয়াইসির এক আচরণে শুরু হয়েছে বিতর্ক। গত মঙ্গলবার শপথবাক্য পড়ে ওয়াইসি বলে ওঠেন ‘জয় ফিলিস্তিন’ আর এ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক।
সংস্কৃত ভাষার ‘জয়’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘বিজয়’। তবে অনেক ক্ষেত্রে কারও প্রতি সমর্থন বোঝাতেও এ শব্দের ব্যবহার হয়। বলা হচ্ছে, ‘জয় ফিলিস্তিন’ বলে ওয়াইসি তাঁদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
অন্য একটি দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে ওয়াইসি সাংবিধানিক অঙ্গীকার লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সংসদ সদস্যরা। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওয়াইসি।
ভারতের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর সংসদ সদস্য হিসেবে ৫৪২ জনের সঙ্গে শপথ নেন ওয়াইসিও। সংসদ সদস্যদের অনেকে এ সময় করতালি দেন। সাদা কুর্তা পরে ওয়াইসি শপথ মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান। উর্দু ভাষায় পাঠ করেন শপথবাক্য।
শপথ পড়তে গিয়ে ওয়াইসি বলেন, ‘আমি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, লোকসভা (ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ) সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি, আল্লাহর নামে শপথ করছি যে আমি ভারতের সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকব। আমি ভারতের আধিপত্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করব। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো আনুগত্যের সঙ্গে পালন করব।’
শপথ পাঠ শেষে মঞ্চ থেকে নামার আগে তিনি ‘জয় ভীম’, ‘জয় মীম’, ‘জয় তেলেঙ্গানা’, ‘জয় ফিলিস্তিন’ বলে স্লোগান দেন।
ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের সমর্থনে জয় ভীম স্লোগান দেওয়া হয়। ভীম শব্দটি দিয়ে মূলত দেশটির সংবিধানপ্রণেতা ও রাজনৈতিক নেতা ভীমরাও আম্বেদকরকে বোঝায়। হিন্দু ধর্মের বর্ণ প্রথার সবচেয়ে নিচু শ্রেণির বলে বিবেচিত হয় দলিতরা। এই সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন আম্বেদকর।
মীম উর্দু বর্ণমালার একটি হরফ। এর উচ্চারণের সঙ্গে ইংরেজি ‘এম’ বর্ণের মিল আছে। ‘জয় মীম’ স্লোগানে ওয়াইসি তাঁর দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) বুঝিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। দলটি এমআইএম বা মীম নামে বেশি পরিচিত। ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে ওয়াইসির জন্ম। অন্যদিকে প্যালেস্টাইন শব্দকে উর্দু ও হিন্দি ভাষায় ফিলিস্তিন বলা হয়।
আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ভারতীয় লোকসভার পাঁচবারের নির্বাচিত সদস্য। তার নির্বাচনী এলাকা তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদ। তাঁর পরিবার রাজনৈতিক। ওয়াইসির বাবা সালাহউদ্দিন ওয়াইসি ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ছয়বার হায়দরাবাদের এমপি ছিলেন।
২০০৮ সাল থেকে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এআইএমআইএমের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মুসলমানদের অধিকার রক্ষা এবং দলিত সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সব ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা আঞ্চলিক দলটির অন্যতম রাজনৈতিক ইশতেহার। সংসদে জ্বালাময়ী বক্তব্যের জন্য আলোচিত এই রাজনীতিবিদ।
সবশেষ নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) কিংবা কংগ্রেস পরিচালিত বিরোধী জোট ইন্ডিয়া—কোনোটিরই অংশ ছিল না এআইএমআইএম।
বিজেপি সদস্যদের দাবি, ওয়াইসি ভারতীয় সংবিধানবিরোধী কাজ করেছেন। দলটির তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রধান অমিত মালভিয়া মঙ্গলবার সামাজিক মাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ফিলিস্তিনের মতো বিদেশি একটি দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের কারণে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী আসাদউদ্দিন ওয়াইসি লোকসভার সদস্যপদের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন।
অমিত মালভিয়া তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে ভারতীয় সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ছবি তুলে পোস্ট করেন। তাতে বলা আছে, অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলে সংসদে সদস্য পদের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হওয়ার বিধানটি তিনি চিহ্নিত করে দেন তিনি।
তবে অন্য এক বিশেষজ্ঞ বলেন, ওই অধিবেশনে তিনি যদি প্রচলিত প্রথার বাইরে কোনো কথা বলেন থাকেন, তাতেও কোনো আইন ভঙ্গ হয়নি। কারণ, অনেক রাজনৈতিক নেতাই এমনটা করেছেন।
রাজনীতিক বিশ্লেষক ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি ভাষার শিক্ষক অপূর্বানন্দ আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না ওয়াইসি লোকসভার সদস্য হিসেবে অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন। কারণ শপথ নেওয়ার সময় প্রায় সব সদস্যই ভিন্ন ভিন্ন স্লোগান দিয়েছেন।’
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ওয়াইসি তাঁর শপথ পাঠ শেষ করেই ফিলিস্তিনের সমর্থনে স্লোগান দেন। শপথবাক্যে তিনি ভারতের প্রতিই আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছেন। ফিলিস্তিনের সমর্থনে স্লোগান দিলে ভারতীয় সংবিধানের লঙ্ঘন হয় না।
বিজেপির ছত্র পাল সিং গাঙ্গওয়ার ‘জয় হিন্দু রাষ্ট্র’ বলে তাঁর শপথ শেষ করেন। তাঁর এই স্লোগানের প্রতিবাদে পাল্টা স্লোগান দেন ইন্ডিয়া জোটের সংসদ সদস্যরা।
ভারত সাংবিধানিকভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সমাজবাদী দলের নেতা অখিলেস যাদব ওই স্লোগানে আপত্তি জানিয়ে বলেন, এটি ছিল সাংবিধানিক মূল্যবোধবিরোধী।
অতুল গার্গ নামে অন্য এক বিজেপি সদস্য শপথ গ্রহণ শেষে ‘নরেন্দ্র মোদি জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দেন। সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলের কটাক্ষের মুখে পড়েন তিনি। পরে তিনি আবার মঞ্চে এসে ‘ড. হেডগেওয়ার (আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার) জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেন।
রাহুল গান্ধীসহ বিরোধীদলীয় কংগ্রেস পার্টির অনেক নেতা এবার সংবিধান হাতে নিয়ে শপথ গ্রহণ করেন। সমাজবাদী দলের অখিলেশ যাদবও এভাবে শপথ নেন। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে তাঁরা এমনটা করেছেন। তবে মোদি ও বিজেপির অন্য নেতারা এভাবে শপথ নেওয়াকে কংগ্রেসের হঠকারিতা বলে সমালোচনা করেন।