শাপুরজি শাকলাতভালা। ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ টাটা পরিবারের একজন সদস্য। তবে মানুষের কাছে অতটা পরিচিত নন। কারণও আছে। টাটা পরিবারের অন্য সবাই যেমন নিজেদের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দেখভালে নিয়োজিত থাকেন, তেমনটি করেননি শাকলাতভালা। বেছে নিয়েছিলেন সংগ্রামী এক পথ।
শাপুরজি সম্পর্কে জানতে হলে ফিরতে হবে শত বছরের বেশি সময় আগে। তখন ভারতে চলছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। সে সময় প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক চরিত্র ছিলেন শাপুরজি। এশিয়া থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম সদস্য ছিলেন তিনি। সেখানে বসেই ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করেছিলেন। এমনকি মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন তিনি।
শাপুরজির জন্ম ১৮৭৪ সালে। তাঁর বাবা দোরাবজি শাকলাতভালা ছিলেন সুতা ব্যবসায়ী। মা জেরবাই ছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামসেদজি টাটার বোন। শাপুরজির ছেলেবেলাতেই তাঁর মা–বাবার বিচ্ছেদ হয়। ১৪ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে মুম্বাইয়ে টাটা পরিবারের এসপ্লানেড হাউসে চলে যান। সেখানে তাঁর অভিভাবক ছিলেন চাচা জামসেদজি।
‘ফিফথ কমান্ডমেন্ট’ নামে শাপুরজির আত্মজীবনী লিখেছেন তাঁর মেয়ে সেহরি। সেখানে তাঁর জীবন সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়। বইয়ে সেহরি লিখেছেন, শাপুরজিকে সব সময়ই খুব স্নেহ করতেন জামসেদজি। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে বড় সম্ভাবনা দেখেছিলেন। ভরসা রাখতে শাপুরজির সক্ষমতার ওপর। এ কারণে সব সময় তাঁর খোঁজখবর রাখতেন জামসেদজি।
বোনের ছেলের প্রতি এই ভালোবাসাকে ভালো চোখে নেননি জামসেদজির বড় ছেলে দোরাবজি টাটা। ‘ফিফথ কমান্ডমেন্ট’ বইতে সেহরি লিখেছেন, ছেলেবেলায়—এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তাঁদের মধ্যে একধরনের দ্বন্দ্ব ছিল। ওই সম্পর্ক কখনোই জোড়া লাগেনি। একপর্যায়ে পারিবারিক ব্যবসা থেকে শাপুরজিকে দূরে ঠেলে দেন দোরাবজি। এরপর ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করেন শাপুরজি।
শাপুরজি যখন কলেজে পড়াশোনা করতেন, তখন ওয়ালডেমার হাফকাইন নামে একজন রুশ বিজ্ঞানীর সঙ্গে সখ্য হয় তাঁর। জারবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতির কারণে নিজ দেশ থেকে পালাতে হয়েছিল তাঁকে।
১৮ শতকের নব্বইয়ের দশকে মুম্বাইয়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ। পারিবারিক টানাপোড়েনের মধ্যে ওই রোগে মানুষের মৃত্যু শাপুরজিরকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে ওই মহামারি দরিদ্র ও শ্রমিকশ্রেণিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। অন্যদিকে তাঁর পরিবারসহ সমাজের উচ্চশ্রেণি ছিল তুলনামূলক সুরক্ষিত।
ওই মহামারির সময় শাপুরজি কলেজে পড়াশোনা করতেন। তখন ওয়ালডেমার হাফকাইন নামে একজন রুশ বিজ্ঞানীর সঙ্গে সখ্য হয় তাঁর। জারবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতির কারণে নিজ দেশ থেকে পালাতে হয়েছিল তাঁকে। প্লেগ প্রতিরোধে হাফকাইন একটি টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। শাপুরজিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওই টিকা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতেন।
শাপুরজির জীবনে প্রভাব ফেলা আরেকটি ঘটনা ছিল স্যালি মার্শের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। ১৯০৭ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। মার্শ ছিলেন ১২ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। শৈশবে বাবাকে হারান তাঁরা। এ কারণে তাঁদের পরিবারে সব সময় আর্থিক টানাপোড়েন লেগেই থাকত। সংসার চালাতে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো সবাইকে।
বিত্তবান পরিবারের হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্র পরিবারের মার্শের হাত ছাড়েননি শাপুরজি। বিয়ের আগে যখন তাঁরা প্রেম করছিলেন, তখন যুক্তরাজ্যের শ্রমিকশ্রেণির কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে পরিচিত হন শাপুরজি। এ ছাড়া স্কুল ও কলেজজীবনে খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ও নানদের কাছে পড়ালেখা করেছিলেন তিনি। তাঁদের স্বার্থহীন জীবনযাপনও শাপুরজির ওপর বড় প্রভাব ফেলেছিল।
১৯০৫ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন শাপুরজি। এর পরপরই রাজনীতিতে পা রাখেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। ১৯০৯ সালে যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টিতে যোগ দেন শাপুরজি। এর ১২ বছর পর যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। ভারত ও যুক্তরাজ্যে শ্রমিকশ্রেণির অধিকার রক্ষায় মন দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বাস করতেন—সাম্রাজ্যবাদ নয়, শুধু সমাজতন্ত্রই দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারে। দেশের শাসনব্যবস্থাতেও মানুষের অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয় সমাজতন্ত্র।
সমাজতন্ত্র নিয়ে শাপুরজির কঠোর মতাদর্শ প্রায়ই ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা মহাত্মা গান্ধীর মতাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠত। দুজনের উদ্দেশ্যই ভারতের স্বাধীনতা হলেও অহিংস পথে তা অর্জনের পক্ষে ছিলেন গান্ধী।
শাপুরজির ভাষণগুলো মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। শিগগিরই তিনি জনপ্রিয় একটি মুখে পরিণত হন। ১৯২২ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয় পান। প্রায় সাত বছর ধরে এই পার্লামেন্টের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়টাতে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন শাপুরজি। এ বিষয়ে তিনি এতটাই দৃঢ় ছিলেন যে পার্লামেন্টের ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন সদস্য তাঁকে ‘ভয়ংকর কট্টর কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সদস্য থাকাকালে ভারত সফরেও এসেছিলেন শাপুরজি। সেখানে দেওয়া বিভিন্ন ভাষণে ভারতের শ্রমিকশ্রেণি ও তরুণ জাতীয়তাবাদীদের প্রতি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। ভারতে সফর করা এলাকাগুলোয় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়াকে সংগঠিত করতে সহায়তাও করেছিলেন তিনি।
সমাজতন্ত্র নিয়ে শাপুরজির কঠোর মতাদর্শ প্রায়ই ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা মহাত্মা গান্ধীর মতাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠত। দুজনের উদ্দেশ্যই ভারতের স্বাধীনতা হলেও অহিংস পথে তা অর্জনের পক্ষে ছিলেন গান্ধী। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, তা নিয়েও অসন্তোষ ছিল শাপুরজির। গান্ধীকে মানুষের দেওয়া ‘মহাত্মা’ নামও পছন্দ হয়নি তাঁর। এ নিয়ে খোলাখুলিভাবে সমালোচনা করেছিলেন শাপুরজি। তবে এত মতবিরোধের পরও স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁরা সব সময় ঐক্যবদ্ধ ছিলেন।
ভারত সফরকালে শাপুরজি যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে নাখোশ হন ব্রিটিশ কর্মকর্তারা। ১৯২৭ সালে তাঁর ভারত ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এর দুই বছর পর ১৯২৯ সালে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আসন হারান। এরপরও ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন শাপুরজি।
তবে নিজের সংগ্রামের ফসল দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি শাপুরজি শাকলাতভালার। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। এর আগে ১৯৩৬ সালে মৃত্যু হয় শাপুরজির। শেষকৃত্যের পর তাঁর ভস্ম লন্ডনে মা–বাবা ও জামসেদজি টাটার পাশে সমাধিস্থ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকার পর আবারও টাটা পরিবারের সঙ্গে মিলিত হন শাপুরজি শাকলাতভালা।