ভোটের প্রতীকী ছবি
ভোটের প্রতীকী ছবি

ভারতে এত দফায় ভোট কেন

ভারতের লোকসভা ভোট কেন এত দিন ধরে এতগুলো দফায় হয়, সেই হেঁয়ালির রহস্য এবারও উন্মোচিত হলো না। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার যে ব্যাখ্যাই দিন না, নিরপেক্ষ দৃষ্টি ও বিশ্লেষণে তা যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য মনে করার কোনো কারণ নেই। ভোটের তফসিল ঘোষিত হওয়ার দিন থেকে ভোট গণনার দিন পর্যন্ত কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার প্রায় স্থবির হয়ে থাকে। এই অচলাবস্থা কী করে কমানো যায়, সেদিকে নজর না দিয়ে নির্বাচন কমিশন দফার সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে এবং সেটা তারা করছে এমনভাবে, যা ব্যাখ্যাহীন তো বটেই, হাস্যকরও।

এবারের ভোট শুরু হতে চলেছে ১৯ এপ্রিল থেকে। শেষ হবে আগামী ১ জুন। ভোট হবে মোট ৭ দফায়। এই ৭ দফাজুড়েই ভোট হবে ৩টি রাজ্যে। উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ। কমিশনের যুক্তি, তিনটিই বড় রাজ্য। ভোট যাতে নির্বিঘ্নে, নিরুপদ্রবে, অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে হতে পারে, সে জন্যই এই বন্দোবস্ত। এই যুক্তি অকাট্য মেনে নিলে প্রশ্ন ওঠে, মহারাষ্ট্রও তো বড় রাজ্য। ৪৮টি আসন সেখানে। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ক্ষুরধার। তাহলে সেখানে কেন পাঁচ দফায় ভোট? কর্ণাটক ও রাজস্থানও কম বড় রাজ্য নয়। সেখানে ভোট কেন দুই দফায়? ওডিশা, মধ্য প্রদেশ ও ঝাড়খন্ডে তিন দফায়? এর চেয়েও বড় কথা, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, তেলিঙ্গানা, গুজরাট, কেরালার মতো রাজ্যে ভোট করানো হচ্ছে এক দিনে, এক দফায়! এবার এক দিনে ভোট হবে ২২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। সেই সব অঞ্চলের মানুষ ভাগ্যবান, কেননা এই প্রবল দাবদাহে তাঁদের ভাজা ভাজা হতে হবে না।

প্রশ্ন আরও অনেক। সব চেয়ে বড় প্রশ্ন কাশ্মীর নিয়ে। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর সেখানে এই প্রথম লোকসভার ভোট (বিধানসভার ভোট কবে হবে কেউ জানে না) হতে চলেছে। বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর কাশ্মীর আবার ভূস্বর্গ হয়ে গেছে বলে কেন্দ্রীয় সরকার নিত্য দাবি করে চলেছে। সেখানকার মানুষ নাকি ভয়হীন চিত্তে দিন যাপন করছে। সন্ত্রাসের দিন শেষ। পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় নাকি তার প্রমাণ। তাই যদি সত্য হয়, তাহলে জম্মু-কাশ্মীরের ৫টি আসনের ভোট এবার কেন পাঁচ দফায় করানো হচ্ছে? কোন যুক্তিতে? এই হেঁয়ালিও উত্তরহীন এবং এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, কেন্দ্রীয় সরকার যা-ই দাবি করুক, জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে তারা মোটেই নিশ্চিত নয়।

যুক্তি ভারতের বৈচিত্র্য ও বিশালত্বের

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, ভারত বিশাল এক দেশ। জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি হবে তো কম নয়। এত বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘনবসতি এক দেশে এক দিনে ভোট করানো সম্ভবপর নয়। স্বাধীনতার পর ভারতে লোকসভার প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৫২ সালে। সেই ভোট দীর্ঘায়িত হয়েছিল নানা কারণে। অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। ভোট গ্রহণের লোকবলও (জনসংখ্যা নয়) ছিল কম। তাই ১৯৫১ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় চার মাস ধরে হয়েছিল সেই ভোট। সেটা ছিল শীতের সময়। নেতা ও ভোটার দুই পক্ষের কাউকেই আজকের মতো কষ্ট করতে হয়নি। এখন ভোট হয় গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহের মধ্যে। কোথায় সব পক্ষকে স্বস্তি দেবে তা নয়, কমিশন বাড়িয়েই চলেছে দুর্দশার বহর!

এ বিষয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে দেশের বিরোধীরা মোটেই একমত হতে পারছেন না। সিইসি বলেছেন, দেশের বিশালত্ব ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থান দেখা জরুরি। দেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র নদীনালা, রয়েছে জঙ্গল, পাহাড়। একদিকে প্রচণ্ড গরম, অন্যদিকে বরফের শীতলতা। রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভেদজনিত অসন্তোষ। তীব্র রেষারেষি। উগ্রপন্থীদের দাপাদাপি। ভোট শান্তিপূর্ণ করতে প্রয়োজন প্রচুর নিরাপত্তারক্ষী। তাঁদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে-আসতেও সময় লাগে। এসবের সঙ্গে দেখতে হয় বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, পরীক্ষা। এত কিছু মাথায় রেখে ভোট নির্ঘণ্ট ঠিক করতে হয়। সেই কারণে দফার সংখ্যা বৃদ্ধি যেমন হয়, তেমনই বেড়ে চলে ভোট পর্বের দিনের সংখ্যা।

বিরোধীরা কিন্তু একমত নয়। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে যেমন বলেছেন, ৭০ থেকে ৮০ দিন ধরে সরকারকে নিষ্ক্রিয় করে রাখাটা কোনো কাজের কাজ নয়। গ্রহণযোগ্যও নয়। সবকিছু বিবেচনায় রেখেও তিন থেকে চার দফায় ভোট করানো সম্ভব। উদ্ধব ঠাকরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রাও এত দফায় ভোট করানো, ৮০ দিন ধরে আচরণবিধি জারি রাখার সমালোচনা করেছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, কোন রাজ্যে কত দফায় ভোট হবে, সিইসি তা ঠিক করে শাসক দলের সঙ্গে আলোচনা করে। তাদের লক্ষ্য একটাই, বিজেপির সুবিধা দেখা। দফা যত বেশি হবে, তত বেড়ে যাবে প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি। প্রচারমাধ্যমজুড়ে বিরাজমান থাকবেন শুধু প্রধানমন্ত্রী। এত দফার ভোট তাদেরই বাড়তি সুবিধা দেয়, যাদের পকেট সবচেয়ে ভারী। বিজেপি সেখানে অদ্বিতীয়।

এবারের সাত দফার ভোটের সঙ্গে অন্য এক প্রশ্নও আলোচিত। নরেন্দ্র মোদির সরকার চাইছে লোকসভা ভোটের সঙ্গে বিধানসভার ভোটও করিয়ে ফেলতে। সেই লক্ষ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে একটি কমিটি গড়া হয়েছে। কমিটি তার রিপোর্টও রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেছে। তাতে সব দিক বিবেচনা করে ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির পক্ষেই মত দেওয়া হয়েছে। এবার লোকসভার ভোটের সঙ্গে ওডিশা, অরুণাচল প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ ও সিকিম বিধানসভার ভোটও হচ্ছে। তাহলে জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা ভোট এই সঙ্গে করানো হলো না কেন? কেন্দ্রের বিচারে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তো ‘স্বাভাবিক’। কেন জম্মু-কাশ্মীরে লোকসভার ভোট করানো হচ্ছে এবং কেন বিধানসভার ভোট হচ্ছে না, তা বোঝার জন্য এবার বিজেপির মূল স্লোগানে নজর দিতে হবে। আসনসংখ্যা ৪০০ পার করতে গেলে কেন্দ্রের পুনর্বিন্যাস ঘটানো কাশ্মীর থেকেও বিজেপিকে আসন জিততে হবে!

ভোটের প্রচার ও ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’

এত দফায় ভোট করানো অন্য এক প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী, ভোট শুরুর আগে ৪৮ ঘণ্টা ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’। ওই সময়টুকু ভোটারকে দেওয়া হয় চিন্তাভাবনা করার জন্য। কে কোন দলকে ভোট দেবে, কোন প্রার্থীকে পছন্দ করবে, তা নির্বিঘ্নে ভাবার জন্য। দফায় দফায় ভোট সেই চিন্তার দফারফা করে ছেড়েছে। ৮০ দিন ধরে ভোট পর্ব চলার দরুন দেশের কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো সময়ে ভোটের প্রচার চলেই। সেই প্রচার টেলিভিশন, রেডিও, খবরের কাগজ, ইন্টারনেট ও বিস্তর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমবাহিত হয়ে চলে আসে সেই অংশেও, যেখানে ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’ চলছে।

সাইলেন্স পিরিয়ড চলাকালীন এলাকায় পাশের কেন্দ্রের প্রচারের ঢেউ ঠেকানোর কোনো উপায় ইসি এখনো বাতলাতে পারেনি। এর ফলে সাইলেন্স পিরিয়ড বাধাহীনভাবে খানখান হচ্ছে। কারও কিছু বলারও থাকে না। কারণ, কলকাতায় সাইলেন্স পিরিয়ড থাকলেও হাওড়ায় প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর প্রচার টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট হতে বাধা নেই। কলকাতার ঘরে ঘরে সম্প্রচারিত হতেও বাধা নেই। খবরের কাগজ মারফত প্রচারেও বাধা নেই। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিত সাইলেন্স পিরিয়ড হাস্যকর হয়ে উঠেছে। যত বেশি দফা, নীরবতার দফারফা তত বেশি।

ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সেইভাবে প্রথম অনুভব করেছিলেন টি এন সেশন। ১৯৯০-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ছিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। তাঁর পর সংস্কারের রাস্তায় আর কেউ সেভাবে হাঁটতে পারেননি। ইদানীংকালে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে সেই চেষ্টাও আর নেই। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক সময় সিবিআইকে ভর্ৎসনা করে সরকারের অনুগত ‘খাঁচার তোতা’ বলেছিলেন। ইদানীংকালে নির্বাচন কমিশনও নিজেদের সেই ভূমিকায় নিয়ে গেছে। কোন রাজ্যে কত দফায় ভোট হলে শাসকের সুবিধা হবে সেটুকু ছাড়া তাদের আর বিশেষ কিছুই দেখার নেই!