নিজেকে যিনি ‘ঈশ্বর প্রেরিত’ ও ‘পরমাত্মার অংশ’ হিসেবে জাহির করেছেন, সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী প্রচার শেষে ধ্যানে বসতে চলেছেন কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রকে। ভোট শেষ হওয়ার আগে তাঁর এই ধ্যানের বিষয়টি যাতে টেলিভিশনের প্রচারের বিষয় না হয়, সে জন্য বিভিন্ন দল নির্বাচন কমিশনের কাছে দরবার করেছে। কী করবে কমিশন, আজ বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত তা অজানা।
ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের এই মিলনস্থলে ভারতের ভূসীমানার ৫০০ মিটার দূরে শেষ শিলায় ১৮৯২ সালে স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যানে বসেছিলেন। ভারতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন হয়েছিলেন। সমুদ্রের বুকে সেই পাথরের টিলার ওপর ১৯৭০ সালে গড়ে তোলা হয় এক স্মারকস্থল। তৈরি হয় এক ধ্যানগৃহ।
এবার লোকসভা নির্বাচনের দীর্ঘ প্রচারপর্ব শেষে নরেন্দ্র মোদি সেখানেই ধ্যানমগ্ন হওয়ার কথা জানিয়েছেন। সে জন্য আজ বৃহস্পতিবারই তাঁর কন্যাকুমারী পৌঁছানোর কথা। আজ সন্ধ্যা থেকেই শুরু করার কথা ধ্যান। মোদি ঠিক করেছেন, দুদিন তিনি মৌনব্রতও অবলম্বন করবেন। মোদির সেই সিদ্ধান্ত জন্ম দিয়েছে রাজনৈতিক বিতর্কের।
পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের মে মাসে লোকসভা ভোটের প্রচারপর্ব শেষ হওয়ার পরদিনই মোদি চলে গিয়েছিলেন হিমালয়ের তুষারতীর্থ কেদারনাথে। সেখানে এক গুহায় তিনি ধ্যানে বসেছিলেন। গেরুয়া চাদরে মোড়া প্রধানমন্ত্রীর ধ্যানমগ্ন ছবি টেলিভিশন মারফত ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। এবারও তিনি ঠিক সেটাই করতে চাইছেন।
মোদি ধ্যানে যখন বসবেন বলে ঠিক করেছেন, তখন সারা দেশের প্রচারপর্ব শেষ হলেও শেষ দফার ভোট গ্রহণ বাকি। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যের ৫৭ আসনের ভোট ১ জুন। বিরোধীরা মনে করছেন, ভেবেচিন্তেই মোদি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যাতে শেষ পর্বের ভোট গ্রহণের সময়ও তিনি প্রচারের আলোয় থাকতে পারেন।
কংগ্রেস মনে করছে, এটা হলে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই আদর্শ নির্বাচন আচরণবিধি ভঙ্গ করবেন। ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনও লঙ্ঘন করবেন। কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি, রণদীপ সিং সুরযেওয়ালা ও নাসির হুসেন গতকাল বুধবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে একটি স্মারকলিপি জমা দেন।
কংগ্রেসের চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, ৩০ মে সন্ধ্যা থেকেই শুরু হচ্ছে নীরবতা পর্ব বা সাইলেন্স পিরিয়ড। ওই সময়টুকু দেওয়া হয় প্রচার শেষে ভোটাররা যাতে ভোটদান নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। মোদি ধ্যান বসলে দেশের সব টেলিভিশন তা নিয়ে হইচই করবে। প্রত্যক্ষ না হলেও সেটা হবে পরোক্ষ প্রচার। তাতে ভোটাররা প্রভাবিত হবেন। চিন্তা করার অবকাশ পাবেন না। মোদি নিজেই এবারের পর্বে বারানসিতে প্রার্থী। সেখানকার ভোটও হবে শেষ দফায়। কাজেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবেন।
কংগ্রেসের বক্তব্য, ধ্যান করার অধিকার প্রধানমন্ত্রীর অবশ্যই আছে। বিবেকানন্দ রকে গিয়ে তিনি দুদিন ধ্যানমগ্ন হতেই পারেন। মৌনব্রতও রাখতে পারেন। কিন্তু তা নিয়ে যেন টেলিভিশন বা অন্যান্য গণমাধ্যম প্রচার না করে। সেই নির্দেশ কমিশনকে দিতে হবে।
একই দাবি তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। এভাবে ভোটের আগে পরোক্ষ প্রচারের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেছেন, ধ্যান করতে চাইলে করুন। কিন্তু টিভিতে তা যাতে দেখানো না হয়, খবরের কাগজে যাতে প্রচার না হয়। নির্বাচন কমিশনকে বিষয়টি দেখতে হবে। মোদিকে কটাক্ষ করে তাঁর প্রশ্ন, কেউ কি ক্যামেরা নিয়ে ধ্যান করতে যান?
এবার ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদি বিশেষ নজর দিয়েছেন দাক্ষিণাত্যে। সে কারণে তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটকের বড় বড় মন্দিরে তিনি গিয়েছেন। রামেশ্বরমে সমুদ্রে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছেন। বিজেপির শীর্ষ নেতাদের দাবি, তামিলনাড়ু ও কেরালায় তাঁরা এবার অভাবিত ফল করবেন।
কন্যাকুমারীতে বিবেকানন্দ রকে ধ্যান করার সিদ্ধান্ত হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটিয়ে শেষ পর্বের ভোটে বিজেপির বাজিমাত করার লক্ষ৵ বলেই বিরোধীরা একমত। এখন দেখার, বিরোধীদের দাবি মেনে নির্বাচন কমিশন ধ্যানরত প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও খবর প্রচারে রাশ টানে কি না।