বিলকিস বানুর ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকার দেশের কাছে কোন দৃষ্টান্ত রাখতে চাইছে তা নিয়ে বিরোধীরা একযোগে প্রশ্ন তুলেছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন, নারীশক্তি নিয়ে যাঁরা মিথ্যা স্তোক দেন, তাঁরা দেশের নারীদের কোন বার্তা দিতে চাইছেন? প্রধানমন্ত্রীর কথা ও কাজের মধ্যে কী দুস্তর ফারাক, গোটা দেশ তা দেখছে।
চারদিকের এই সমালোচনা সত্ত্বেও বিলকিস বানুর ধর্ষক ও তাঁর পরিবারের খুনিদের মুক্তি দেওয়া প্রসঙ্গে আজ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ছিল চুপ। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি কেউ মুখ খোলেননি।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২১ বছর বয়সী গৃহবধূ বিলকিস বানু। সে সময় তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ধর্ষকেরা বিলকিসের তিন বছর বয়সী কন্যাসহ পরিবারের সাত সদস্যকে খুন করেছিলেন। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০০৮ সালে ১১ অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ১৪ বছর কারাবাসের পর সেই অপরাধীদের সাজা মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নেয় গুজরাট সরকার। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, অপরাধীরা ১৪ বছর জেল খেটেছেন। জেলে তাঁদের আচরণ, বয়স ও অপরাধের প্রকৃতি বিবেচনার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও ধর্ষণ ও খুনের আসামিদের শাস্তি না কমানো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত নীতি।
বিলকিস বানুর ধর্ষক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুনের আসামিরা যেদিন মুক্তি পান, সেদিনই লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে এমন একটা বিকৃতি এসেছে যে আমরা কথায় কথায় নারীদের অপমান করি। শব্দ প্রয়োগ, আচরণ, ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নারীদের অসম্মান করি। এর থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়া দরকার।’
ওই ভাষণের উল্লেখ করে বুধবার প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে এক টুইটে রাহুল বলেন, ‘গোটা দেশ আপনার কথা ও কাজের ফারাক দেখতে পাচ্ছে।’ কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ এ ঘটনাকে ‘নির্লজ্জ বেহায়া’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘কেউ কি বিশ্বাস করবে গুজরাট সরকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া এই কাজ করেছে?’
কংগ্রেসের আর এক মুখপাত্র পবন খেরার প্রশ্ন, ‘মিস্টার মোদি, গোটা পৃথিবী তাকিয়ে আছে। কী করবেন আপনি?’ সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাট বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি হলো, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুনের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের শাস্তি কমানো যাবে না। এ ঘটনার পর নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মূল্যহীন হয়ে যায়। দ্বিচারিতার উদাহরণ হয়ে থাকে।’
তেলেঙ্গানার মন্ত্রী কে টি রাম রাও আজ টুইটে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই নারীর সম্মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তা হলে এ ঘটনায় অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করুন।’
বিরোধীরা মনে করছেন, গুজরাট বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই এই সিদ্ধান্ত। ঠিক এভাবে উত্তর প্রদেশ বিধানসভার নির্বাচনের আগে লখিমপুর খেরি জেলায় গাড়ি চালিয়ে কৃষক হত্যার দায়ে অভিযুক্তকেও জামিন দেওয়া হয়েছিল। বিলকিস বানুর ধর্ষকদের শাস্তি মওকুফ করার পেছনেও রয়েছে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা। সেই কারণে জেলখানার বাইরে মুক্তি পাওয়া ওই অপরাধীদের ফুলের মালা পরিয়ে কপালে তিলক কেটে মিষ্টি খাইয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। হায়দরাবাদের এমআইএম নেতা আসাউদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, ধর্মীয় পরিচিতি বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত। গোটা ঘটনায় বিচলিত ভারত সরকারের সাবেক মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু বলেন, এ ঘটনা শুধু নৈতিক অবক্ষয়ের পরিচয় নয়, বিশ্বদরবারে ভারতের লজ্জাও।
বিলকিস বানুর পরিবারকে বাড়ি দেওয়ার যে নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছিল, তা অপূর্ণ রয়ে গেছে। বিলকিসের স্বামী ইয়াকুব সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এখনো তাঁদের মাথা গোঁজার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই।