দিল্লিতে এনডিএ জোটের বৈঠকে শরিক দুই নেতার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি। আজ ৫ জুন
দিল্লিতে এনডিএ জোটের বৈঠকে শরিক দুই নেতার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি। আজ ৫ জুন

জয়ের পরও কেন মোদির উঁচু মাথা নিচু হলো

বিজেপি সদর দপ্তরে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিজয়োল্লাসের ছবি দেখলে মনে হবে, সেটা যেন পাঁচ বছর আগের বিজয় উৎসবের হুবহু জলছবি। কর্মী–সমর্থকদের উচ্ছ্বাস, ফুলের পাপড়ির অবিরাম বর্ষণ, ‘মোদি’ ‘মোদি’ পাগলামির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সহাস্য আবির্ভাব ও বরণ সবকিছুই ঠিক আগের মতো। অথচ তার মধ্যে যেন লুকিয়ে ছিল সহমরণে যাওয়া সতীর আর্তনাদ। জয় সত্ত্বেও অসম্মানের গ্লানি ঢাকার এক প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। নরেন্দ্র মোদি বিজয়ী হলেও সেই আয়োজন থেকে ঠিকরে বের হচ্ছিল পরাজয়ের বেদনা। এই জয়োল্লাস মোদির ব্যর্থতা হিসেবেও চিহ্নিত থাকবে।

আগের বারের তুলনায় বিজেপি এই ভোটে ৬৩ আসন কম পেয়েছে। ২৪০ আসনে থমকে যাওয়ার অর্থ সরকার গঠনের ম্যাজিক ফিগার থেকে ৩২ কদম দূর। বিস্ময় এটাই, এই ৬৩ আসনের মধ্যে ৪৪টি আসন বিজেপি হারিয়েছে তিন রাজ্য—উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা ও রাজস্থান—যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি!

এই বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ দলিত মন ঘুরে যাওয়া। ২০১৪ সালে কংগ্রেসবিরোধী হাওয়ায় ভেসে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে জাতপাতনির্ভর হিন্দি বলয়ে নতুন সামাজিক জনবিন্যাসের দিকে তাঁরা মনোযোগী হন। দলিত ও অনগ্রসরদের কাছে টানতে শুরু হয় বিজেপির ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’। বহুজন নেত্রী মায়াবতী যে দলিতদের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে বেঁচে রয়েছেন, সেই জাটভ দলিতদের বাদ দিয়ে অন্যদের কাছে টানতে মোদি–শাহ জুটি সক্রিয় হন।

যেমন পাসোয়ান, খটিক, ধোবি, কোরি, বাল্মীকি। সেই সঙ্গে টার্গেট করেন অনগ্রসরদের। এই মেরুকরণ কতটা কাজের হয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা ও ২০২২ সালের বিধানসভার ভোটের ফল তার প্রমাণ। এবারের ভোট বিজেপির সেই অস্ত্র ভোঁতা করে দিয়েছে। যে মায়াবতীকে ছেড়ে জাটভ দলিত বিজেপিতে চলে গিয়েছিল, তারা তো বিরোধী জোটে ফিরেছেই, মায়াবতীর ঘরও খালি হয়ে গেছে। ২০২২ সালে পাওয়া ১৯ শতাংশ ভোটের মধ্যে ১০ শতাংশ আশ্রয় নিয়েছে ইন্ডিয়া জোটে। একটিও আসন জোটেনি এবার তাঁর। এই দুরবস্থা তাঁর আগে হয়নি। হয়নি বিজেপিরও।

আর এটা করেছেন প্রধানত রাহুল গান্ধী। তাঁর কৌশলেই হোঁচট খেয়েছে মোদির বিজয় রথ। বলা ভালো, কংগ্রেসের হাতে সেই অস্ত্রও তুলে দিয়েছিলেন বিজেপির নেতারাই। কর্ণাটকের অনন্ত কুমার হেগড়ে, রাজস্থানের জ্যোতি মির্ধার মতো অন্তত চার–পাঁচজন বিজেপি নেতা ও প্রার্থী এবার চার শ আসন কেন চাই, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁদের কথায়, চার শ আসন পাওয়ার অর্থ দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাসিল, যা সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজন।

নির্বাচনী প্রচারেও বিরোধী নেতারা তুলে ধরেছেন মোদির স্বৈরাচারী চরিত্র। তাঁরা বুঝিয়েছেন, গণতন্ত্র রসাতলে যাওয়ার অর্থ ও বিপদ কী। বহু অরাজনৈতিক মানুষ, যাঁরা নানা কারণে মোদিকে সমর্থন করলেও অন্ধ ভক্ত হয়ে ওঠেননি, তাঁরা এই প্রচারে যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন।

কংগ্রেস ওটাকেই হাতিয়ার করে। তারা প্রচার শুরু করে, আম্বেদকরের সংবিধানকে আরএসএস কখনো মন থেকে মেনে নেয়নি, যেহেতু সেখানে ‘মনুস্মৃতি’ অনুপস্থিত। ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী আরএসএস দলিত, অনগ্রসর, আদিবাসী, তফসিলদের ঢালাও সংরক্ষণেরও বিরোধী। চার শ আসন পেয়ে তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলে তারা আম্বেদকরের সংবিধান বদলে সংঘের সংবিধান চালু করবে। তুলে দেবে সংরক্ষণের সুবিধা। একের পর এক জনসভায় রাহুল গান্ধী সংবিধান ও আম্বেদকরের ছবি তুলে বোঝাতে থাকেন, এ কারণেই বিজেপিকে হারানো দরকার।

ভারতের দলিতদের অহংকার ও গর্বের জায়গা একটাই। বাবাসাহেব আম্বেদকর ও তাঁর তৈরি সংবিধান। বঞ্চিত, নিপীড়িত, সর্বস্তরে অবহেলিত, অত্যাচারিত দলিতদের কাছ থেকে সেই অহংকার ও গর্ব কেড়ে নেওয়ার অর্থ সব শেষ হয়ে যাওয়া। সব আশার জলাঞ্জলি হওয়া। কংগ্রেসের এই প্রচার ‘ইন্ডিয়া’ শরিকেরাও হাতিয়ার করে। অখিলেশ, মমতা, উদ্ধব, তেজস্বী, শারদ পাওয়ারের মতো নেতারা রাজ্যে রাজ্যে সংবিধান বদলের বিপদের কথা জানাতে থাকেন। বিজেপি এর মোকাবিলায় পুরোপুরি ব্যর্থ। ৩৭টির বেশি সংরক্ষিত আসনে বিজেপির হার তার প্রমাণ।

নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা হারানোর দ্বিতীয় কারণ সেনাবাহিনীর ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প। চার বছরের এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রতিটি সেনা পরিবারে সৃষ্টি করেছে এক প্রবল অসন্তোষ। চার বছর পর যাঁরা থোক কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে আসবেন, সেই যুব সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ মোদি সরকার অনিশ্চিত রেখে দিয়েছে। বিরোধীরা এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছে।

রাহুল জানিয়েছেন, ক্ষমতায় এলে তাঁরা এই প্রকল্প বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে পুরোনো নিয়োগ পদ্ধতিতে ফিরে যাবেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বদলে ফিরিয়ে আনবেন স্থায়ী নিয়োগ। বাহিনীতে দুই শ্রেণির জওয়ান সৃষ্টি করবেন না। রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ ও বিহারে এর ফল দেখা গেছে।

দলিত, অনগ্রসর, তফসিলদের এই জাতিগত উষ্মার পাশাপাশি বিজেপির বিরুদ্ধে এসব অঞ্চলে জড়ো হয়েছে কৃষক অসন্তোষ। যে হরিয়ানার ১০টি আসনই গতবার বিজেপি পেয়েছিল, সেখানে এবার ৫টি কেড়ে নিয়েছে কংগ্রেস। পাঞ্জাবে সাফ হয়ে গেছে বিজেপি। ক্ষমতায় এলে ফসলের সহায়ক মূল্যের আইনি স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি বিরোধীদের প্রত্যাশা বাড়িয়েছে। এই ত্রিমুখী প্রচারের অভিমুখ ঘোরাতে মোদি চেষ্টার অন্ত রাখেননি। খাড়া করেছেন মুসলমান জুজু। টেনে এনেছেন রামমন্দির নির্মাণ। ভয় দেখিয়েছেন মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেওয়ার। লাভ হয়নি।

তৃতীয়বার মোদি নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু শুরু থেকেই সব দিক থেকে চাপে থাকবেন নরেন্দ্র মোদি। সরকারে তাঁকে চাপে রাখবেন চন্দ্রবাবু নাইডু, নীতীশ কুমার, জয়ন্ত চৌধুরী, চিরাগ পাসোয়ানেরা, সরকারের বাইরে উজ্জীবিত কংগ্রেসসহ গোটা বিরোধীকুল।

শাসনের দ্বিতীয় পর্বে গোটা বিশ্বে আলোচিত হতে থাকে নরেন্দ্র মোদির ‘কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরতন্ত্রী’ আচরণ, মানবাধিকার হরণ, চরম অসহিষ্ণুতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বসহ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ সংক্রান্ত নানা অভিযোগ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ভি–ডেম ইনস্টিটিউট, পিউ রিসার্চসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিবেদন নরেন্দ্র মোদির একনায়কতন্ত্রের সমালোচনায় মুখর হয়। আন্তর্জাতিক সূচকগুলোয় ভারতের ক্রমাগত অধঃপতন আলোচিত হতে থাকে সারা দেশে। সেই বিরূপ সমালোচনাও মোদিকে সজাগ করেনি। কর্তৃত্বে রাশ টানেননি। ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগের মতো সংস্থাকে দিয়ে বিরোধীদের যত তিনি দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন, ততই জোটবদ্ধ হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’।

নির্বাচনী প্রচারেও বিরোধী নেতারা তুলে ধরেছেন মোদির স্বৈরাচারী চরিত্র। তাঁরা বুঝিয়েছেন, গণতন্ত্র রসাতলে যাওয়ার অর্থ ও বিপদ কী। বহু অরাজনৈতিক মানুষ, যাঁরা নানা কারণে মোদিকে সমর্থন করলেও অন্ধ ভক্ত হয়ে ওঠেননি, তাঁরা এই প্রচারে যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন। বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার তার অন্যতম প্রমাণ। যে মোদি গতবার বারানসিতে সাড়ে চার লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন, এবার তিনি সেখানে জিতেছেন মাত্র দেড় লাখ ভোটে! যত ভোটে মোদি জিতেছেন, তার চেয়ে বেশি ভোটে আমেথিতে হেরেছেন তাঁর স্নেহধন্য স্মৃতি ইরানি।

তৃতীয়বার মোদি নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু শুরু থেকেই সব দিক থেকে চাপে থাকবেন নরেন্দ্র মোদি। সরকারে তাঁকে চাপে রাখবেন চন্দ্রবাবু নাইডু, নীতীশ কুমার, জয়ন্ত চৌধুরী, চিরাগ পাসোয়ানেরা, সরকারের বাইরে উজ্জীবিত কংগ্রেসসহ গোটা বিরোধীকুল। এই চাপ রূপান্তর ঘটালে তৃতীয় দফায় দেখা যেতে পারে এক অপেক্ষাকৃত নমনীয়, বিনীত, গণতন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। যিনি ঈশ্বরপ্রেরিত নন, পরমাত্মার অংশও নন এবং অবশ্যই নশ্বর।