উত্তর প্রদেশে বিপর্যয় কেন, তা নিয়ে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। কারণ, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেই কাটাছেঁড়া শুরুই করেনি। তবে বিজেপির প্রদেশ নেতৃত্বের একাংশ ইতিমধ্যেই একে অন্যের প্রতি দোষারোপ শুরু করে দিয়েছেন। আবার বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ব বাহিনী গাল পাড়তে শুরু করেছে প্রধানত অযোধ্যার হিন্দু সমাজকে। সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে তোলপাড় চলছে।
পশ্চিম উত্তর প্রদেশে জেতার জন্য বিজেপি এবার খুবই তৎপর ছিল। জাট ও মুসলমান অধ্যুষিত ওই অঞ্চলে কৃষক আন্দোলনের রেশ পড়েছিল ভালোভাবেই। ভোটে তার প্রভাব কাটাতে বিজেপি জাট কৃষকনেতা প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী চরণ সিংকে ‘ভারতরত্ন’ দেয় ও এরপর তাঁর নাতি রাষ্ট্রীয় লোকদলের নেতা জয়ন্ত চৌধুরীকে সমাজবাদী পার্টির জোট থেকে ভাঙিয়ে এনডিএ জোটে শামিল করে। এভাবে তারা ভেবেছিল ওই তল্লাটের অধিকাংশ আসনে জয় নিশ্চিত করবে। অথচ ৪ জুন ফল প্রকাশের পর দেখা গেল মুজফফরনগর, সাহারানপুর, কৈরানা, সম্ভল, নাগিনা, মোরাদাবাদের মতো আসনে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কাছে গোহারান হেরেছেন বিজেপি ও এনডিএ প্রার্থীরা। এর পর থেকেই শুরু হয়ে গেছে ওই তল্লাটের দুই বিজেপি নেতা সঞ্জীব বালিয়ান ও সংগীত সোমের একে অন্যের প্রতি বিষোদ্গার।
সঞ্জীব ও সংগীত দুজনেই কৃষিপ্রধান পশ্চিম উত্তর প্রদেশের কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা। দুজনের বিরুদ্ধেই ঘৃণা ভাষণ, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি ও দাঙ্গায় জড়িত থাকার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সঞ্জীব ২০১৪ ও ২০১৯ সালে মুজফফরনগর লোকসভা কেন্দ্রের জয়ী প্রার্থী। মোদি সরকারের দ্বিতীয় দফায় মন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু এবার তিনি সমাজবাদী প্রার্থী হরেন্দ্র সিং মালিকের কাছে হেরে গেছেন।
সংগীত সোম মিরাটের প্রভাবশালী ঠাকুর (রাজপুত) নেতা। ওই জেলার সারদানা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ২০১২ ও ২০২২ সালে জিতেওছিলেন। এবার ভোট শুরুর আগে থেকেই তিনি সঞ্জীবের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেন। ফল বেরোনোর পর সঞ্জীব প্রকাশ্যেই বলছেন, সংগীত দলবিরোধী কাজ করে সমাজবাদী প্রার্থীর জয়ে সাহায্য করেছেন। পাল্টা সংগীত বলেছেন, তাঁকে পার্টি যে দায়িত্ব দিয়েছিল তা তিনি পালন করেছেন। সারদানা কেন্দ্র বিজেপি জিতেছে। সঞ্জীবের আত্মানুসন্ধান করা উচিত কেন উনি হারলেন। সংগীত ও তাঁর অনুগামীদের অভিযোগ, সঞ্জীবের লাগামছাড়া দুর্নীতি তাঁর পতনের কারণ।
এই চাপান–উতরের মধ্যেই সংগীতের করা এক অভিযোগ ভাইরাল হয়েছে। যেখানে সঞ্জীবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ আনা হয়েছে। বিদেশে সম্পত্তি কেনার অভিযোগও রয়েছে। সংগীত অবশ্য জানিয়েছেন, ওই অভিযোগ তিনি করেননি। তাঁর নামে অন্য কেউ তা প্রচার করেছে।
এবার ভোটের আগে গুজরাটের বিজেপি নেতা, সাংসদ ও মোদি সরকারের সদস্য পুরুষোত্তম রুপালা রাজপুতদের সম্পর্কে কিছু কুমন্তব্য করেছিলেন। তার রেশ ধরে গুজরাট, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশের রাজপুত মহলে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। রাজস্থান ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশে বিজেপির বিপর্যয়ের সেটা একটা কারণ মনে করা হচ্ছে। বিজেপির অন্দর মহলের ধারণা, ঠাকুর (রাজপুত) নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সহ রাজ্যের ঠাকুর সম্প্রদায়ের (সংগীতও সেই সম্প্রদায়ভুক্ত) ‘নীরব ও পরোক্ষ অসহযোগিতা’ খারাপ ফল হওয়ার একটা কারণ। যদিও তা প্রমানহীন। বিশ্লেষকেরা দেখিয়েছেন, এবার দলিত ভোট ব্যাপকহারে কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টিতে চলে গেছে। যে কারণে মায়াবতীর দল বহুজন সমাজ পার্টির ভোট শেয়ার ২০ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। তাঁর দল একটিও আসন জেতেনি। জিতেছে সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস।
বিজেপির ধারণা ছিল, অযোধ্যায় রামমন্দিরের জাঁকজমক উদ্বোধন হিন্দুত্ববাদের লহর তুলবে। সেই চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রচারও চালিয়েছিলেন। অথচ দেখা গেল, খোদ অযোধ্যাতেই (কেন্দ্র ফৈজাবাদ) বিজেপি প্রার্থী হেরে গেলেন! শুধু ওই একটি আসনেই নয়, অযোধ্যাকে ঘিরে আম্বেদকর নগর, বস্তি, বরাবাঁকি, আমেথি, সুলতানপুর, রায়বেরিলি কেন্দ্রেও বিজেপি কুপোকাত। অনগ্রসর অধ্যুষিত আসন ‘এটা’ থেকে রামমন্দির আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা বিজেপির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত কল্যাণ সিং বরাবর জিতে এসেছেন। তাঁর পুত্র রাজবীর সিংকে এবার ওই আসনে বিজেপি প্রার্থী করেছিল। বিস্ময়করভাবে হেরেছেন তিনিও। প্রতিটি আসনে দলিত ও অনগ্রসর ভোটের বেশিটা চলে গেছে ইন্ডিয়া জোটে। এর পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে ভয়ংকরভাবে শুরু হয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণ। আক্রমণের লক্ষ্য? সেটাও বিস্ময়করভাবে অযোধ্যার হিন্দু সমাজ!
উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যা ইচ্ছে তাই বলে চলেছেন হিন্দু ভোটারদের উদ্দেশে। উসকানি দিয়েছেন বিজেপির গেরুয়াধারী নেতা উন্নাওয়ের সংসদ সদস্য সাক্ষী মহারাজও। তিনি বলেছেন, ‘এই অযোধ্যার জমি হিন্দু করসেবকদের রক্তে ভেসে গিয়েছিল। আমি নিজে হাতে করে নিহত করসেবকদের সরিয়েছি। দুর্ভাগ্য, সেই অযোধ্যাবাসীরা সমাজবাদী পার্টিকে জেতাল!’
সামাজিক মাধ্যমে কেউ ‘দুমুখো হিন্দুদের’ সমালোচনা করেছেন, কেউ–বা স্থানীয় ধোবি (ধোপা, দলিত) সম্প্রদায়কে গালি দিয়েছেন সমাজবাদী পার্টির দলিত প্রার্থীকে সমর্থনের জন্য, কেউ আবার হিন্দুদের গালাগাল করে লিখেছেন, ‘ওরা নপুংসক।’
উত্তর প্রদেশের পুলিশ দুয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি ছড়ানোর অভিযোগও আনা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। ধৃত ব্যক্তিদের মধ্যে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী সেই স্বঘোষিত নেতাও রয়েছেন, যিনি দিল্লির কংগ্রেস প্রার্থী কানহাইয়া কুমারকে চড় মেরে তাঁর গালে কালি লেপে দিয়েছিলেন।
বিজেপির অভ্যন্তরেও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের এই গালিগালাজ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। প্রতিবাদও করছেন কেউ কেউ। যদিও বিরোধী নেতারা বেশি সরব। আর সরব হয়েছেন অযোধ্যার রামমন্দিরের প্রধান পুরোহিত আচার্য সত্যেন্দ্র দাস। তিনি বলেছেন, ‘হিন্দুত্বের নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যেভাবে হিন্দু সমাজকে দোষারোপ করছেন, তা বোকামি। ভগবান রামকে তাঁরা ভোটে জেতার হাতিয়ার করে তুলেছিলেন। এই আচরণ ঘৃণ্য।’
রামমন্দির তৈরির মধ্য দিয়ে বিজেপির প্রবল ঢক্কানিনাদের মধ্যে চাপা পড়ে গিয়েছিল ব্যাপক দুর্নীতি, জবরদস্তি জমি অধিগ্রহণ, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার গাদা গাদা অভিযোগ। সাধারণ মানুষের দুর্দশা ও অভিযোগের প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি বিজেপি ও প্রশাসন। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের অযোধ্যাকে তৈরি করা হয়েছে ‘ফাইভ স্টার তীর্থক্ষেত্রে’, যেখানে প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেই ব্যাপক অসন্তোষের ঢেউ পৌঁছেছে সীতাপুর, বস্তি, প্রয়াগরাজ, প্রতাপগড়েও। এমনকি বারানসিও বাদ যায়নি। সেখানে উন্নয়ন ও মন্দিরের করিডর তৈরির নামে জনরোষ যেভাবে দমিয়ে রাখা হয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে ভোটে। সাড়ে পাঁচ লাখ ভোটে জেতা নরেন্দ্র মোদির ভোট ব্যবধান নেমে এসেছে দেড় লাখে। চন্দ্রশেখর ছাড়া এত কম ভোটের ব্যবধানে ভারতের আর কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী কখনো জয়ী হননি।
সত্য হলো, সারা ভারতের মতো উত্তর প্রদেশেও বিজেপি রামের নামে ভোট লড়েনি। লড়েছিল মোদির নামে। হার যদি তাই কারও হয়ে থাকে, তা নরেন্দ্র মোদির। কিন্তু সেই সত্য স্বীকারের ক্ষমতা বিজেপির নেই। তারা এখনো ভোটের পর্যালোচনাই শুরু করেনি।