বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে যে গান প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল, সেই ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’ ভালোভাবেই ছড়িয়েছে ভারতে; বিশেষ করে পূর্ব ভারতে। পশ্চিমবঙ্গে যে গণ-আন্দোলন চলছে, সেখানে গানটি গাইছেন সাধারণ মানুষ, গানটি বাজানো হচ্ছে লাউডস্পিকারে। অনেক সময় প্রথম লাইনটি অবিকৃত রেখে কথা বা সুর পরিবর্তন করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে সরকার এ গান গাওয়ার জন্য এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
তবে আসামে গানটির প্রথম লাইন অবিকৃত রেখে গাওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজ্যের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আলতাপ হুসেনকে। অভিযোগ, তাঁর গান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত হেনেছে। গানটির কারণে রাজ্যে হিন্দু-মুসলমান বিবাদ বাড়বে।
‘অহম তোমার বাপের নাকি, মিয়া খেদিব খুজা’—হলো গানের প্রথম দুই লাইন। বাংলা করলে এমন হয়—আসাম কারও বাপের নাকি, খুঁজে খুঁজে মিয়া বা বাঙালি মুসলমানকে চিহ্নিত করে তাদের বিদায় করার এই প্রক্রিয়া আর কত দিন চলবে।
স্পষ্টভাবেই এ গানে নাম না করে সমালোচনা করা হয়েছে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার বাঙালি মুসলমান নীতির। তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে বাঙালি মুসলমানবিরোধী তাঁর যে রাজনৈতিক বয়ান, তা আবার সামনে এনেছেন।
বিধানসভায় দিন কয়েক আগে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন, বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা আসামে দ্রুত বাড়ছে। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যাবে না। আসামকে তিনি মুসলমানপ্রধান রাজ্য হতে দেবেন না।
বিধানসভায় বিশ্বশর্মার করা মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেসসহ একাধিক বিরোধী দল থানায় অভিযোগ করে। অতীতে কংগ্রেস মুসলমানদের সমর্থনে বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে মামলা করেনি এই ভয়ে যে তাদের হিন্দু ভোট ভাগ হয়ে যাবে। এবার তারা সেটা করল।
ধারণা করা হচ্ছে, আসামে বাঙালি মুসলমানপ্রধান দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের জনপ্রিয়তা মুসলমান সমাজে কমার সঙ্গে সঙ্গে আবার নতুন করে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করেছে। সেটা মাথায় রেখে মুসলমান সমাজের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে মুসলমানের পক্ষ নিয়ে বিশ্বশর্মা আসামে ধীরে ধীরে মাঠে নামছে কংগ্রেস।
শুধু এ ঘটনা নয়, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কয়েক দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে কথা বলছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। দিন কয়েক আগে তিনি মন্তব্য করেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে ২০৫০ সালের মধ্যে আসাম মুসলমানপ্রধান রাজ্যে পরিণত হবে।
বাঙালি মুসলমানরা মূলত আসামের দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশে বসবাস করেন। কাজের জন্য তাঁরা ‘আপার’ বা উজান আসামেও যান। মুখ্যমন্ত্রী তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, বাঙালি মুসলমানরা কেন দলে দলে উজান আসামে কাজ করতে যাবেন? এই কাজের সুযোগে তাঁরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এ ছাড়া আসাম বিধানসভায় সম্প্রতি নামাজের বিরতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক চলছে।
তবে শুধু আসাম নয়, পাশের রাজ্য মেঘালয়ের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (ইউএসটিএম) প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মাহবুবুল হককেও বিপদে ফেলেছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। বেশ কিছুদিন ধরেই মাহবুবুল হক সম্পর্কে মন্তব্য করার পরে জনপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও সরাসরি মন্তব্য করেছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা।
অধ্যাপক মাহবুবুল হক সংবাদমাধ্যমকে জানান, ইউএসটিএমের ছাত্রদের আসামে সরকারি চাকরি থেকে নিষিদ্ধ করা হতে পারে বলে হিমন্ত বিশ্বশর্মার মন্তব্যের পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি ব্যাপক পরিমাণে কমে গেছে।
আসামে প্রায় ৩৫ শতাংশ মুসলমান, যাঁদের মধ্যে বড় সংখ্যায় বাঙালি মুসলমান। আসামে মুসলমান জনসংখ্যার বিষয়টি স্বাধীনতার সময় থেকে এমন একটি ইস্যু, যা নিয়ে কথা বললেই রাজ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং অন্যান্য বিষয় চাপা পড়ে যায়। সেটা মাথায় রেখেই বাঙালি মুসলমান ইস্যু নিয়ে মাঝেমধ্যেই সরব হন আসামের মুখ্যমন্ত্রী।
আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে হিমন্ত বিশ্বশর্মা বাঙালি মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে নতুন করে যে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন, সে পরিপ্রেক্ষিতেই আলতাপ হুসেন তাঁর গান বেঁধেছেন। আসামের নিজস্ব বিহুনাচের সঙ্গে গানটি বেঁধেছেন তিনি। গানটি কয়েক দিনে প্রবল জনপ্রিয় হয়। এরপরই তাঁকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে গ্রেপ্তার করে আসাম পুলিশ।
আলতাপকে গ্রেপ্তারের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী গানের সঙ্গে বিহুনাচ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আসামে কোনো অবস্থাতেই ‘মিয়া বিহু’ চালু করতে দেওয়া হবে না।