ভারতের মুম্বাইয়ে শনিবার রাতে গুলি করে হত্যা করা হয় মহারাষ্ট্রের বিধায়ক ও সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিককে। এ হত্যাকাণ্ডে সন্দেহের তির যাচ্ছে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের দিকে। কারাগারে থাকা ব্যক্তিটি একটি কুখ্যাত গ্যাংয়ের (অপরাধী চক্র) মূল হোতা। সাম্প্রতিক এ হত্যাকাণ্ড ও অভিনেতা সালমান খানকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছেন বিষ্ণোই ও তাঁর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
বিষ্ণোই বর্তমানে গুজরাট রাজ্যের সবরমতি কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। সেখান থেকেই পরিচালনা করছেন গ্যাং সদস্যদের এক বিশাল ও ধাঁধানো নেটওয়ার্ক।
সিদ্দিক হত্যাকাণ্ডে বিষ্ণোইয়ের জড়িত থাকার সন্দেহ তিন দশক আগের ‘গ্যাং যুদ্ধ’ ও মুম্বাইয়ে গত শতকের সত্তরের দশকে সংঘটিত নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডকেই আবার ফিরিয়ে আনার শঙ্কা জাগিয়েছে। ওই সব কর্মকাণ্ডে আবু সালেম, ছোট রাজন ও দাউদ ইব্রাহিমের মতো ব্যক্তিদের নাম জড়িয়ে আছে।
একজন লরেন্স বিষ্ণোই কারাগারে থেকে কীভাবে এত বড় গ্যাং নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। প্রকৃতপক্ষে ‘বিষ্ণোই গ্যাং’ ছোটখাটো কোনো সিন্ডিকেট নয়। এটির তৎপরতা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের নানা দেশে।
কিন্তু একজন লরেন্স বিষ্ণোই কারাগারে থেকে কীভাবে এত বড় গ্যাং নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।
প্রকৃতপক্ষে ‘বিষ্ণোই গ্যাং’ ছোটখাটো কোনো সিন্ডিকেট নয়। এ গ্যাংয়ের তৎপরতা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের নানা দেশে।
কারাবন্দী থেকেও উদ্দেশ্য হাসিলে দেশ ও দেশের বাইরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখা, নির্যাতন–নিপীড়ন চালানো এবং হুমকি দেওয়ার কাজটি বিষ্ণোই করে থাকেন ওই বিশাল অপরাধী চক্রের মাধ্যমেই।
ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) দাবি, শক্তিশালী ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং খালিস্তিনপন্থী সংগঠনসহ বিভিন্ন জোটকে কাজে লাগিয়ে কারাগারে থেকে তৎপরতা চালাতে সক্ষম হচ্ছেন বিষ্ণোই।
নিউজ১৮ নামের একটি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ইচ্ছে করেই জামিন আবেদন করেন না বিষ্ণোই। সেই সঙ্গে ‘ডাব্বা কলিং’ (ফোনকল) ও ভিওআইপির (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) মাধ্যমে সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন তিনি।
বিষ্ণোইয়ের মতো বড় অপরাধীরা বর্তমানে ‘ডাব্বা কলিং’ নামের যোগাযোগের নতুন কৌশল অবলম্বন করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রচলিত মোবাইল নেটওয়ার্কের নজরদারি এড়িয়ে এই পদ্ধতিতে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা সম্ভব।
এনডিটিভির খবর অনুযায়ী, বিষ্ণোই ভারতের ভেতর ও বাইরে সিগন্যাল, টেলিগ্রামের মতো অ্যাপস ব্যবহার করে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এ বছরের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিওটেপ ভাইরাল হয়। ধারণা করা হয়, সেটি ছিল লরেন্স বিষ্ণোই ও পাকিস্তানভিত্তিক গ্যাংস্টার শাহজাদ ভাট্টির মধ্যকার কথোপকথনের।
বিষ্ণোইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন গ্যাংস্টার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া জশবিন্দার সিং ওরফে রকি। পাঞ্জাবের ফাজিলকা এলাকা থেকে তিনি বিষ্ণোইকে রাজস্থান–পাঞ্জাব সীমান্তের শ্রী গঙ্গানগর, ভারতপুরের মতো শহরে তাঁর তৎপরতার বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করেন।
হিমাচল প্রদেশে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংস্টার জয়পাল ভুল্লারের হাতে ২০২০ সালের মে মাসে নিহত হন রকি। এনআইএ বলছে, ভারতের পাঁচটি রাজ্যে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের ৭ শতাধিক বন্দুকধারী সদস্য রয়েছেন। এই সদস্যদের রয়েছে বিদেশেও যোগাযোগ। শুটারদের মধ্যে অন্তত ৩০০ জনই পাঞ্জাবের।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দলে তরুণদের নিয়োগ দেয় এ গ্যাং। অনেক সময় কানাডার মতো পশ্চিমা দেশগুলোতে অভিবাসী হিসেবে যাওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয় তাঁদের।
বিষ্ণোই গ্যাংকে বিদেশে তৎপরতা চালাতে সহায়তা করে থাকেন হরবিন্দর সিং রিন্ডার মতো খালিস্তানপন্থী ‘সন্ত্রাসীরা’। পাঞ্জাবে নিশানা করা কাউকে খুন করতে হরবিন্দর সিং বিষ্ণোইয়ের শুটারদের কাজে লাগান বলে অভিযোগ রয়েছে। দাউদ ইব্রাহিমের ‘ডি–কোম্পানি’র কর্মকাণ্ডে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্যরা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন বলে কথিত আছে। বিষ্ণোই গ্যাং একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করে, যা অনেকটা ডি-কোম্পানির মতো।
আগ্নেয়াস্ত্রের বিপুল সংগ্রহ ছাড়াও বিষ্ণোই গ্যাংয়ের রয়েছে বিভিন্ন বিভাগ ও কর্মী বাহিনী। তথ্য সংগ্রহ, আইনি বিষয়গুলো দেখভাল করা ও লজিস্টিকস সমর্থন দেওয়া তাদের কাজ।
গ্যাংস্টার জাগ্গু ভগবানপুরিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বিষ্ণোইয়ের। আছে গ্যাংস্টার সাম্পাথ নেহরা ও কালা জাথেডির সঙ্গেও বন্ধুত্ব। বিষ্ণোইয়ের ঘনিষ্ঠ অংশীদারদের একজন গোল্ডি ব্রার। গোল্ডি মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা ও বন্দুকধারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কাজ করেন।
লরেন্স বিষ্ণোইয়ের নাম জোরেশোরে সামনে আসে ২০২২ সালে। সে বছর ২৯ মে পাঞ্জাবের জনপ্রিয় গায়ক সিধু মুসওয়ালাকে হত্যা করা হয়। বিদেশ থেকে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন গোল্ডি। তিনি জানান, বিষ্ণোইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুসওয়ালাকে হত্যা করেছেন তিনি। তখন বিষ্ণোই দিল্লির তিহার কারাগারে বন্দী।
২০২৩ সালে ভারতের ডানপন্থী নেতা সুখদেব সিং গোগামেদিকে জয়পুরে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সুখদেবের সঙ্গে অস্ত্রধারী একজন চা পান করছেন। তিনিই গুলি চালান। পরে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্য রোহিত গোদারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে সুখদেবকে হত্যার দায় স্বীকার করেন।
২০১৮ সালে বলিউড তারকা সালমান খানকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে বিষ্ণোই গ্যাং। সে বছর মুম্বাইয়ে সালমানের বাসায় হানা দেন সাম্পাথ নাথ নামে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের এক সদস্য। তিনি দাবি করেন, কালো হরিণ শিকারের কারণে সালমানকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁর ওপর। বিরল প্রজাতির এ হরিণকে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন।
সালমানকে সরাসরি হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন লরেন্স বিষ্ণোই। ভারতের যোধপুরে আদালতে এক শুনানি চলাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘সালমান খানকে এই যোধপুরেই হত্যা করা হবে। এরপর তিনি আমাদের সত্যিকারের পরিচয় জানতে পারবেন।’
এরপর ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় সালমানের বাসার বাইরে গুলি চালানো হয়। এ এলাকাতেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বাবা সিদ্দিক। সালমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও ছিল তাঁর।
লরেন্স বিষ্ণোইয়ের বয়স বেশি নয়। ১৯৯৩ সালে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে জন্ম তাঁর। ২০১০ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন কেটেছে রাজ্যের আবোহার শহরে। এরপর তিনি ডিএভি কলেজে ভর্তি হতে চণ্ডীগড়ে পাড়ি জমান। ২০১১ সালে যোগ দেন পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস স্টুডেন্টস কাউন্সিলে। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় ‘গ্যাংস্টার’ গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে। এরপর ধীরে ধীরে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। রয়েছে হত্যা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ। যদিও এসব অভিযোগের কোনোটাই স্বীকার করেননি তিনি।
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে চণ্ডীগড়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড শুরু করেন বিষ্ণোই। ২০১৩ সাল নাগাদ তিনি ত্রাস সৃষ্টিকারী এক চরিত্রে পরিণত হন। কয়েকটি হত্যার ঘটনার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ে। পরে তাঁর গ্যাং মদ বেচাকেনা ও অস্ত্র চোরাচালানে অর্থ লগ্নি করা শুরু করে। হত্যাকারীসহ ভয়ংকর অপরাধীদেরও আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে আসছে তারা।