দিল্লি ‘অচল’ করে জি–২০ সম্মেলন

জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন ঘিরে দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করেছে ভারত।
ছবি: এএনআই

যদি বলা হয় লকডাউনে রাজসিক যজ্ঞ, মোটেই বাড়াবাড়ি হবে না। কিংবা যদি বলা হয়, জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রাণহীন দিল্লিতে, সেটাও অতিশয়োক্তি হবে না মোটেই।

আজ বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুরু করে রোববার পর্যন্ত দিল্লির প্রাণকেন্দ্র ‘নিউ দিল্লি’ জেলার হাল এমনই হতে চলেছে। শীর্ষ সম্মেলন নিরুপদ্রব ও নির্বিঘ্ন করে তুলতে কেন্দ্রীয় সরকার ও দিল্লি পুলিশ যা যা করছে, আজ পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রাজধানীর হাল তেমন হয়নি।

নিউ দিল্লি বা ‘লুটিয়েন্স দিল্লি’ বলতে সেই এলাকাকে বোঝায়, যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সব রথী–মহারথীর বাস। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকাংশ দপ্তর অবস্থিত। যেখানে পার্লামেন্ট ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের অবস্থান। কনট প্লেস, খান মার্কেট, বেঙ্গলি মার্কেটের মতো বিশাল ও অভিজাত বাজার রয়েছে, আছে ইন্ডিয়া গেট জুড়ে মনোরম সবুজের রমরমা। বড় বড় হোটেল, মিউজিয়াম। এক কথায় বিশ্বের পর্যটকেরা যে অঞ্চলে বছরভর ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন, এই নিউ দিল্লি এলাকা তা–ই।

এই জেলার মধ্যেই নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মেলনস্থল ‘ভারত মন্ডপম’, অনেক আগে যার নাম ছিল ‘প্রগতি ময়দান’। এই ভারত মন্ডপমেই হতে চলেছে দুই দিনের জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন। সে জন্য সেজেগুজে দিল্লি প্রস্তুত। অথচ কাল থেকে সেখানে প্রাণের স্পন্দন অনুভূত হবে না। হবে না কারণ, গোটা নিউ দিল্লি জেলাকে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে বেঁধে দিয়েছে দিল্লি পুলিশ।

বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর থেকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে দিল্লি জেলার মধ্যে থাকা সব বাণিজ্য এলাকা

বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর থেকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে কনট প্লেস, খান মার্কেট, গোল মার্কেট, বেঙ্গলি মার্কেটসহ নিউ দিল্লি জেলার মধ্যে থাকা সব বাণিজ্য এলাকা। কোনো দোকান খোলা হবে না সোমবার ভোরের আগে। বন্ধ রাখতে হবে সব সিনেমা-থিয়েটার হল। কোনো সরকারি যান চলবে না। শনি ও রোববার বন্ধ থাকবে দিল্লি শহরের রাস্তার পরিচিত অটোরিকশা, ট্যাক্সি। বেসরকারি যান চলাচলও বন্ধ থাকবে ওই তল্লাটে। বৈধ পাসধারী ছাড়া সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ।

বিমানবন্দর থেকে মূল শহরে আসার জন্য ন্যাশনাল হাইওয়ে খোলা রাখা হবে শুধু সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। বাকিদের ঘুর পথে শহরে যাওয়ার রাস্তা বাতলানো হয়েছে।

সম্মেলন এলাকার আশপাশে ড্রোন প্রতিরোধী ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে

এই ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচতে বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা ‘ইন্ডিগো’ তাদের কয়েকটি পরিষেবা বন্ধ রাখছে বলে জানিয়েছে। রাষ্ট্রীয় নেতাদের বিশেষ বিমান রাখার কারণে বিমানবন্দরেও ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই রব উঠেছে। হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ বিদেশি এয়ারক্র্যাফট রাখতে। রাজধানীর ভালো কোনো হোটেলে একটি ঘরও খালি নেই। সরকার আগে থেকে সব বুক করে ফেলেছে।

বিমানবন্দর বা রেলস্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যেতে–আসতে যাত্রীদের টিকিট বা হোটেল বুকিংয়ের প্রমাণ দিতে হবে। নইলে পুলিশ থেকে ছাড় মিলবে না। দেশ–বিদেশের সাংবাদিকদের হাল সবচেয়ে খারাপ। ভারত মন্ডপমে যেতে হলে তাঁদের প্রত্যেককে সকাল ছয়টায় হাজির হতে হবে দক্ষিণ দিল্লির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে। সেখান থেকে ভারত মন্ডপম যেতে–আসতে ভরসা বিশেষ শাটল বাস।

বৈধ পাস নিয়ে ভারত মন্ডপমে গাড়ি নিয়ে যাওয়া গেলেও সেখানে পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ওই অঞ্চলে যাওয়ার জন্য মেট্রোরেলের একমাত্র স্টেশন, যার নাম ‘সুপ্রিম কোর্ট স্টেশন’, তা টানা তিন দিন বন্ধ থাকবে। ওই স্টেশনে কোনো মেট্রো থামবে না। কাজেই সংবাদমাধ্যমের এত মাত্র গতি সরকারি শাটল বাস।

নিউ দিল্লি এলাকার বাসিন্দাদের বলা হয়েছে, তিন দিনের বাজারহাট সবাই যেন আগেভাগে সেরে ফেলেন। অফিস–কাছারি, স্কুল–কলেজ, মলসহ সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে বাসিন্দাদের বলা হয়েছে অনাবশ্যক ঘোরাফেরা না করতে। এমনকি তিন দিন প্রাতর্ভ্রমণ না করারও পরামর্শ দিল্লি পুলিশের পক্ষে দেওয়া হয়েছে।

শুধু তা–ই নয়, নিউ দিল্লি জেলায় তিন দিন জোমাটো, সুইগি, অ্যামাজনের মতো সংস্থা খাবার বা অন্য কিছু ডেলিভারি দিতে পারবে না। এই তিন দিন ২০০–এরও বেশি প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এই তিন দিন দিল্লি মেট্রো ভোর চারটা থেকে চালানো হবে। কিন্তু নিউ দিল্লি পুরো বন্ধ থাকার ফলে কে বা কারা তাতে চাপবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

সম্মেলন উপলক্ষে কনট প্লেস সাজানো হয়েছিল। সে জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ৪ কোটি রুপি। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ থাকবে বলে এই অনিন্দ্যসুন্দর মার্কেট প্লেসের সৌন্দর্য বিদেশি অতিথিরা উপভোগ করতে পারবেন না। কনট প্লেসের ব্যবসায়ী সংগঠনের আক্ষেপ, তিন দিনে শুধু তাঁদের বাণিজ্যিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪০০ কোটির টাকার কাছাকাছি।

লকডাউন শব্দে প্রবল আপত্তি দিল্লি পুলিশের। অথচ যা হচ্ছে তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায় কোভিডকালে জনপ্রিয় হওয়া শব্দ ‘লকডাউন’ ফিরিয়ে এনে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন। প্রাণহীন মহাযজ্ঞ।