ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের বিষ্ণুপুর জেলায় রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িসহ দুটি স্থানে গতকাল শুক্রবার রকেট হামলা চালিয়েছেন বিদ্রোহীরা। এ ঘটনায় রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে একজন নিহত এবং অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন। কয়েক দিন ধরে কয়েক দফায় ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালিয়ে আসছিলেন বিদ্রোহীরা। এর মধ্যে গতকাল প্রথম রকেট হামলা চালানো হলো।
ভারতের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ইতিহাসে আগে কখনো এত ব্যাপক পরিমাণে ড্রোন হামলা চালায়নি কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তবে রকেট হামলা অবশ্য অতীতে হয়েছে।
মণিপুরে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সংঘাত চলছে। এই জাতিগত সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংঘাত ও সংঘর্ষ মাঝেমধ্যে কিছুটা কমলেও হঠাৎ করেই বেড়ে যাচ্ছে। যেমন গত কয়েক দিনে ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তারপর গতকাল রকেট হামলা চালানো হলো।
মণিপুর পুলিশ জানিয়েছে, গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে স্থানীয়ভাবে তৈরি একটি লঞ্চার ব্যবহার করে ময়রাং শহরে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মাইরেম্বাম কোইরেং সিংয়ের বাড়িতে রকেট হামলা চালানো হয়। রকেটটি সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সীমানায় আঘাত হানে।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা বলছেন, বাড়ি থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে রকেটটি আছড়ে পড়ে। এ ঘটনায় ৭২ বছর বয়সী কে রাবেই সিং নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর পাঁচ আত্মীয় আহত হয়েছেন।
এর আগে গতকাল ভোরে বিষ্ণুপুর জেলার ত্রংলাওবি গ্রামে আরও রকেট হামলা চালানো হয়। অবশ্য সেখানে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
কুকি জনগোষ্ঠী–অধ্যুষিত চূড়াচাঁদপুরের পাহাড় থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের কোনো এলাকা থেকে রকেটগুলো ছোড়া হয় বলে জানিয়েছেন এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই প্রথম আমরা মণিপুরে বিদ্রোহীদের নিজেদের তৈরি রকেট হামলা চালাতে দেখলাম। রকেটগুলো মোটামুটি চার ফুট লম্বা।’
রাজ্যে কিছুদিন পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত থাকলেও গত রোববার থেকে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। ড্রোন ও রকেট হামলার পাশাপাশি গুলি চলছে এবং গ্রেনেড হামলা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দূরের গ্রাম থেকে তাঁরা গোলাগুলি ও বোমার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।
মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং বলেছেন, ড্রোনের ব্যবহার প্রমাণ করে যে রাজ্যে ত্রাসের আবহাওয়া তৈরি হয়েছে এবং সন্ত্রাসী হামলা চলছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, নিরাপত্তা বাহিনী উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। উপত্যকার জেলাগুলোর বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের মোতায়েন করা হয়েছে। বিশেষ করে এই মুহূর্তে তারা চূড়াচাঁদপুর সীমান্তবর্তী বিষ্ণুপুর ও কাংপোকপি জেলার সীমান্তবর্তী ইম্ফল থেকে পশ্চিমের দিকে যেতে শুরু করেছে।
বিস্ফোরক বহনকারী ড্রোন ব্যবহার করে আক্রমণের বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই কমিটি সাম্প্রতিক হামলা নিয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, রকেট হামলার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও এই প্রতিবেদনে থাকবে।
সরকারি দায়িত্বে থাকা বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং নিরাপত্তা দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দু-একজন বলেছেন, মণিপুরে পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। কোনোভাবেই রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার আর পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
এ অবস্থায় মণিপুরের অখণ্ডতার সমন্বয়কারী কমিটি এবং রাজ্যে মেইতেইদের শীর্ষ সংস্থা ‘কোকোমি’র তরফে এক বিবৃতিতে ইম্ফল উপত্যকার পাঁচটি জেলায় ‘পাবলিক ইমার্জেন্সি’ বা সামগ্রিক ও স্থানীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার এ রকম কোনো ঘোষণা এখনো দেয়নি।
কোকোমির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জনগণের জীবন রক্ষায় সরকারকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এবার নিজেদের রক্ষা করার জন্য, জনসাধারণকে তাঁদের নিজস্ব পন্থা নির্ধারণ করতে হবে।
ধারণা করা হচ্ছে, এই বিবৃতির মাধ্যমে জনসাধারণকে আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার আবেদন জানাল মেইতেই সমাজের শীর্ষ সংগঠন। এ ঘোষণার ফলে সহিংসতা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
পরিস্থিতির বিচারে মণিপুর সরকার রাজ্যজুড়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ শনিবার থেকে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।